Saturday 13 June 2020

ডোমেস্টিক ওয়ার্কার ললিতার লকডাউন যাপন

 ললিতার লকডাউনের দিন

লকডাউন মানুষকে হাতে হাত মিলিয়ে বাঁচতে শিখিয়েছিল। কিন্তু এই সহমর্মিতার গল্পের পাশে কিছু কান্না লুকিয়ে ছিল। ললিতার মেয়ে টিউশনির পয়সা দিতে পারেনি। তাই লকডাউনে সেই পরিবারে বাসন মেজে ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছিল ললিতা মন্ডলকে।


অভাবের সংসার বরাবর ললিতার ছিল না। স্বামীর অসুস্থতায় পরিবারে নেমে আসে দূর্ভোগ। কাজ খুঁজতে বেরিয়ে পড়ে ললিতা। বাধ সাধে লকডাউন। দুই মাস পর আবার কাজে নামে  ললিতা। অনেক কষ্টে মাসে মাত্র হাজার টাকা উপার্জন হয়। তাও নিশ্চিত নয় প্রতিমাসের জন্য। মাঝপথে কাজ ছাড়িয়ে দিলে টাকা মেলে না দিন হিসেবে।  শ্রমের মর্যাদা নিয়ে গলা ফাটানো এই  সমাজ কিন্তু এদের অধিকারটা বুঝিয়ে দিতে ও কড়ায় গন্ডায় মিটিতে দিতে অপরাগ। কোবিড বিপ্লবে মাস মাইনে না পেয়ে কেঁদে ফিরল রাস্তায় অগণিত মেইড সারভেন্ট। 

বিশ্বজুড়ে একই চিত্র। ইথিওপিয়া থেকে কাজে যাওয়া  ৩৭ জন মহিলা ডোমেস্টিক ওয়ার্কারকে লেবাননের রাজধানীতে রাস্তায় নামিয়ে দেওয়া হল কিছুদিন আগেই। তাদের দেওয়া হল না কাজের পয়সা। ফিরিয়ে  দেওয়া হল না  তাদের পাসপোর্ট।  এমন কি ছুরি দিয়ে ভয় দেখানো হল দেশে ফেরার আবদারে। রাস্তায় আশ্রয় নেওয়া  মহিলার কথা জানাজানি হতেই লেবাননের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয় যে, এই মেইড দের ঘরে রাখার দায়িত্ব নিয়োগকারীদের। লেবাননে  কাফালা নামের  এক সিস্টেমের  মধ্যে দিয়ে এদের নিয়োগ করার ফলে ডোমেস্টিক ওয়ার্কারদের ভিসা নিয়োগকারীর সঙ্গে যুক্ত থাকে। তাই ওদের ঘরে ফেরাটা মালিকের মর্জির উপর নির্ভর করে। ওদিকে নিজের দেশ ইথিওপিয়াও এদের ফিরিয়ে নিচ্ছে না। এয়ার টিকিট শুধু ডলারে নেওয়া হয় ইথিওপিয়ায়। লেবাননে আর্থিক  সংকটের কারনে ডলার আক্সেস করা সম্ভব হচ্ছে না। দুই দেশের নিয়ম ও ব্যবস্থার ফাঁসে আটকে আছে এতজন ডোমেস্টিক স্টাফের ভাগ্য। দেশে ও দেশের বাইরে কাজের মেয়েরা এভাবেই  গভীর সমস্যায় জর্জরিত হচ্ছে। কাজ করেও  অপমান ও অনিশ্চয়তার  জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে ললিতারা।

মুকুন্দবাগ,মুর্শিদাবাদ 

Thursday 4 June 2020

টুনটুনি ও বেলী মেহুলির কোভিডকাল যাপন

টুনটুনি ও বেলীর লকডাউন যাপন

টুনটুনি মেহুলি বছর তিরিশের মহিলা। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনা। তবু জীবন থেমে নেই। ঘর দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন যে, এটি মানুষের বাসস্থান। লকডাউনে কেমন অবস্থা জিজ্ঞাসা করতেই ঝড়ের বদলে বৃষ্টি নেমে এল। অভিযোগ নয়। হতাশাও নয়। হয়ত অভিমান। কেউ আগে বুঝি কেমন আছ? একথাটিও ভুলে জিজ্ঞাসা করেনি! রোগের চিকিৎসা হয়। বিজ্ঞান তাই জানান দেয়। কিন্তু যাদের হয়না তাদের কি হয়? একথা বই এর সিলেবাসে লেখা থাকে না। শুধু দেখে যেতে হয় । এবং ভুলে যেতে  বা এড়িয়ে যেতে হয়।চোখ ফিরিয়ে নেওয়ার শিক্ষা সিলেবাস না দিলেও সমাজ দেয়! তাই হয়ত টুনটুনিরা বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির জয়গান গাওয়ার সুযোগ পায় না। সামনে সুসভ্য শিক্ষিত মানুষ দেখলে ডুকরে কেঁদে ওঠে! আসলে এই  লজ্জা কার এটাই এখন মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন! লকডাউনে  একবেলা আলু সেদ্ধ ।পরদিন একবেলা ভাত জোটে। একবেলা খাবার পাওয়াটাই জীবনের পরম পাওয়া আপাতত। 

বেলী মেহুলির হাতে সমস্যা। আঠাশ বছরের বেলী কাজ করতে পারে না ডান হাতে। একেই মহিলা। তারপরেও হাতের সমস্যা। কাজের হাত ! সব বর্গের সব মানুষের ভিড়ে এইটি বড় সত্য যে, মহিলার হাতটি সচল না হলে তার জীবনে নিশ্চিত বিপর্যয়। গঞ্জনার জীবন বেলীর। সবার মত মাঠে খাটার সুযোগ তার নেই। বাড়িতে অভাবে তাই মুখ ফুটে কিছু বলার ক্ষমতাও নেই। দিনে শুটকি মাছ আর ভাত। রাতে শুধুই আলু সেদ্ধ জুটেছে।    



জীবন আগেই সীমাবদ্ধতায় ভরিয়ে দিয়েছে। এখন পরিবারে এক কোনায় পড়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই। লকডাউন সকলের জীবনে নতুন হলেও টুনটুনি ও বেলীর খুব চেনা এই পরিস্থিতি। ঘরে বসেই কাজ করা। বাইরে যাওয়ার দিনটাই আসেনি। তবু লকডাউনে পরিবারের চাপ এসে পড়েছে। বসে খাওয়ার খোঁটা এসে পড়েছে। তাই অপেক্ষা সব স্বাভাবিক হয়ে ওঠার। মাঠের কাজ শুরু হলে পয়সা তো কিছুটা আসবে হাতে! বেলী বলে, রান্নাঘরে তো এখন শুধুই জলটুকুই পড়ে থাকে! এটাই ক্ষিদে মেটানোর বড় সহায়!   

শারীরিক অসুস্থতার সঙ্গে লড়াই করে  টুনটুনি ও বেলী ক্লান্ত। শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই। তাই উজ্জ্বল কোনও দিনের স্বপ্ন দেখাও নেই। তবু আক্ষেপ লকডাউন না থাকলে সংসারের হাল কিছুটা তো ভালো থাকত! 

নবগ্রাম,মুর্শিদাবাদ 

Tuesday 2 June 2020

মালতী মুর্মুর কোভিডকাল যাপন

মালতীর লকডাউনের দিন

বছর চল্লিশের মালতী। স্বামী সুই মুর্মু মাঠে খাটে। লকডাউনে মাঠের কাজ বন্ধ। ঘরে বসেই দিন কাটছে।মালতীও মাঠে কাজ করে। কিন্তু পয়সা রাখতে পারেনা। স্বামী পয়সা নিয়ে চলে যায় কখন টের পায় না। চাষের মাঠ থেকে দুজনে মিলে যেটুকু ধান পায় তা কেনা-বেচা করেই চলে বছর। এবারে হঠাৎ লকডাউন গুলিয়ে দিয়েছে মালতীদের জীবন। প্রতিদিনের খাওয়া কোনোদিনই নিশ্চিত ছিল না। তবু চলে যেত ভাত-রুটি বদল করে দিন। এবারে সমস্যা ঘরে বসা স্বামীকে নিয়ে। কাজ না থাকলেও নানারকম চাহিদা ও নেশা আছে। তাতে পয়সা লাগে। সেটা না পেলেই বাড়িতে অশান্তি বাড়ছে। এতদিন মাঠে কাজ করে এসেই বাড়ির পুরষ শান্ত থাকত। কাজ না থাকলেও অন্য ব্যস্ততা থাকত। লকডাউনে বেড়েছে অত্যাচার। কাজ নেই কিন্তু অনান্য চাহিদা বেড়েছে।

মালতীদের জীবনে শিক্ষার কোনও জায়গা নেই। বড় হয়েছে অভাবের পরিবারে। বিদ্যালয়ের মুখ দেখা হয়নি। বিয়েটাই বেঁচে থাকার একমাত্র লক্ষ্য বলে জানা ছিল। এটাই ছিল পারিবারিক দায়। তাই বিয়ে একদিন হয়েই গিয়েছিল। কিন্তু জীবনে ভালো কিছু পাওয়ার গ্যারান্টি ছিল না। জন্মস্থলে ও সংসারে অবস্থার কোনও বদল হয়নি। দারিদ্র ছিল জীবনের সবচেয়ে বড় কাছের বন্ধু। মালতী নিজেও জানে সে অপুষ্টির শিকার। ডাক্তার ওষুধ লিখে দিলেও কেনার ক্ষমতা নেই। তাই এভাবেই চলছে দিন। এর মধ্যেই এসে পড়েছে লকডাউনের অভিশাপ।


 

মালতীর লকডাউনের সময় রাতে শুধু শুটকি মাছ আর লবন। দিনে ভাত সেদ্ধ। ঘরে চা পাতা আছে পড়ে সামান্য। চিনি নেই। বিস্কুটও নেই। এদিকে  ইনকাম ও বন্ধ। পাশের বাড়ির সঙ্গে ধান-চাল বিনিময় করে আর কতদিন! ফুরিয়ে আসছে ঘরের জিনিষ একে একে। মালতীদের দিন বড় আবার রাতও  পাল্লা দিয়ে বড় হচ্ছে! এখন সকালের অপেক্ষা। কিন্তু ভোরের আলোতেও সেই এক অন্ধকার! ভাগ্যে লকডাউন জীবনভর। 


নবগ্রাম,মুর্শিদাবাদ 

           


Monday 1 June 2020

জুলিয়ানা হাঁসদার কোভিডকাল যাপন

 জুলিয়ানার লকডাউনের দিন

সভ্যতা মানুষকে শিক্ষিত করে। জীবনের জন্য প্রয়োজনের সব উন্নত কিছুর হদিস দেয়। পদে পদে অমসৃনতার  সামনে পড়া সীমাবদ্ধতাকে জয় করতে শেখায়। কিন্তু সেই সুসজ্জিত সভ্যতার এক কোনায় যখন অন্ধকারের যাপন নজরে আসে তখন থমকে যেতে হয়। পিছুটান হাতছানি দেয়। এই অসহায় মুখগুলিকে আলোর সামনে এসে মুখোমুখি দাঁড় না করতে পারার জন্য অনুশোচনা হয়। এই যন্ত্রণা নিয়ে  আর যাই হোক নিজেকে সুসভ্যতার অংশীদার বলে দাবী করা যায়না। চিকিৎসা ও প্রযুক্তির শিখরে থাকা দেশের কোনও প্রান্তের মানুষ যখন সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয় এবং অসুখের সঙ্গেই বাস করাকেই ভবিতব্য মনে করে তখন বিজ্ঞানও লজ্জায় মুখ লুকায়। জুলিয়ানা হাঁসদার লকডাউনের দিন সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে ক্লান্ত হয়। বেঁচে থাকার অধিকার তো মানুষের মৌলিক অধিকার। খাওয়া ও চিকিৎসার অধিকার তো এর মধ্যেই পড়ে! কিন্তু একাংশ তা থেকে বঞ্চিত কেন হবে! জুলিয়ানাসহ দুই বাচ্চাকে দেখে মনে হল এ যেন আফ্রিকার কোনও অঞ্চলের বুভুক্ষ মানুষের ছবি। যেমন গুগুলে সার্চ করে পাওয়া যায়! অপুষ্টি,বিকলাঙ্গ অসহায় এই বাচ্চা দুটিও এই দেশের ভবিষ্যৎ। তবু নিউ ইন্ডিয়ার সাইনিং এদের মুখে পড়তে ভয় পায়!   

জুলিয়ানার দুই ছেলে। একটির ছয় ও অন্যটির দুই। দুটি বাচ্চাই ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জ। ডাক্তার বলেছে দুইজনের সার্জারি করতে হবে। পয়সা নেই। কোনও উপায় না দেখে জুলিয়ানা ছেলেকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে পালিয়ে আসে। তারপর ছেলে ভর্তি হয় ক্লাস ওয়ান এ। সেখানে সে বুলিং এর শিকার । এই পোড়া দেশে অসুখের নামেও ফান হয়। সহানুভূতির বদলে ল্যাংড়া বলে ডাকা হয়। ছেলে কদিন বিদ্যালয়ে যেতে পারবে জানেনা জুলিয়ানা! শুধু জুলিয়ানার বিশ্বাস ভগবান তাদের সঙ্গে খারাপ কিছু করবে না। ছেলেদের ভগবান বাঁচিয়ে রাখবে। এভাবেই জরুরি চিকিৎসা ছাড়া বেঁচে আছে বাচ্চা দুটো। ভারতবর্ষের ভগবান কতদিন এদের বাঁচাবে কে জানে! 

স্বামী মাইগ্রান্ট লেবার। লকডাউনে ফিরেছে খালি হাতে। তাই অন্য অভিশাপ জুলিয়ানার জীবনে নেমে এসেছে। হাঁড়িতে চাল আছে। রেশনে পাওয়া। আর লবন আছে। সব্জি বলতে এটাই। শুনেছে আলু পাবে। হাতে আসেনি। পেলে সেটা বাজারে বিক্রী করে মশলা কিনবে। ভরসার শাক মাঠে পড়ে। ইচ্ছে করে না জুলিয়ানার তুলে আনতে! শুধু ভাতও কদিন পাবে জানেনা। স্বামীর কাজ নেই। জুলিয়ানা নিজে পড়াশুনা করেনি। অভাবের সংসারে বিয়েটাই বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল ছিল।সেটাই করে দিয়েছিল বাপ-মায়ে। ছেলেদের শিক্ষিত করার বড় স্বাদ! কিন্তু বাঁচাতে পারলে তো! কোবিড নিয়ে জুলিয়ানা কিছু জানেনা। কোভিডে মানুষ মরে! কিন্তু ওরা বেঁচেই বা কবে ছিল। অভাবেই জন্ম অভাবেই শেষ। মাঝে শুধু একটা বিয়ে ও দুইটি বাচ্চা। এইরকম একাধিক জুলিয়ানা ভুগছে প্রতিদিনের অসুখে। পরের প্রজন্মকেও দিয়ে যাচ্ছে দারিদ্রের উত্তরাধিকার! যুগ যুগ ধরে জুলিয়ানাদের ললাট লিখন কি বদলাবে? এদের কপালে লকডাউন লেখা আজীবন। খোলার সাধ্য  জুলিয়ানার বিশ্বাসের  কোন দেবতার! কে জানে!        

 নবগ্রাম,মুর্শিদাবাদ

   



কাথাষ্টিচ শিল্পী সোনালির লকডাউনের দিন

  কাঁথাষ্টিচ শিল্পী সোনালির লকডাউন যাপন    মেয়েদের সুন্দর মুখের নয়, সুন্দর কাজের জয়  সর্বত্র। সাফল্যের সীমানা দিগন্তপার। তাইতো সোনালীদের এত ...