Saturday 25 April 2020

ছেতি হেমব্রমের তালাবন্দি জীবন


ছেতি হেমব্রমের লকডাউনের দিন

"বিশ্বাস করুন,ছিতে হেমব্রম পাগলি নয় ,ভিখারিও নয়।" বলতে বলতে কথা জড়িয়ে যায় ছেতি হেমব্রমের দাদা বদি হেমব্রমের। দেখে বুঝতে অসুবিধে হয় না যে, শুধু অভাব,অপুষ্টি ও অযত্নে এই বেহাল দশা ছেতির। দাদার অভাবের সংসারে এক কোনায় পড়ে থাকে ছিতে। এখন খাবার বলতে সারাদিন একমুঠো মুড়ি আর জল। আগের দিন রাতে জুটেছে শুঁটকি মাছের সামান্য গুঁড়ো আর লবন। দিলে খায়। না দিলে খায় না। এদিকে দাদারও মাঠে চাষের মজুরি খাটা বন্ধ হয়েছে অনেকদিন। টানা লকডাউনে বাড়িতেই বসে। বদি হেমব্রম অসহায় হয়ে বলে,"ছেতি জলটাই খায় বেশি।" ডান হাতের চারটে আঙুল অর্ধেক আছে। বাঁ চোখেও সমস্যা। তাই নাকি সরকারের ঘরে ছাপ পড়েনি। দুই বার গিয়েও আঙুলের ছাপ না ওঠায় আধার কার্ড হয়নি। কার্ড না থাকায় ছেতি সব সরকারী সুযোগ সুবিধার বাইরেই থেকে গেছে। বদি আফসোস করে বলে "বাপ লুদু হেমব্রমের মেয়েটার জন্য কিছুই করতে পারলাম না। কিছুই পেল না জীবনে মেয়েটা।"



ছেতির ছবি হবে শুনে তাড়াতাড়ি দুই পায়ে উঠে দাঁড়াল। হাতের পাশেই লাঠি রাখা ছিল। নিজের চেয়ে আধ হাত বড়। অন্যসময় দুই হাতে ভর দিয়েই চলে। মাটিতে হামাগুড়ি দিয়েই আজীবন কেটে গেছে। দাঁড়িয়ে হাঁটতেও পারে না। এত অসহায় যে মানুষের জীবন হতে পারে তা ছেতিদের না দেখলে বোঝা যায় না। শরীর চলে না,খাবার পেটে পড়ে না নিয়মিত। তবু মুখে হাসি থেমে যায়নি। ছেতির দাদা বদি খুব মর্মাহত হয়ে বলে, "আমার বোন অক্ষম। চলতি পারে না। আমি সারাবছর তার খাবার জোগাড় করতেও পারিনা। এখন তো নিজেই খেতে পেছি না । ওর মুখে কি তুলে দেবো।" পরিবারের এক কোনায় নীরবে পড়ে থাকা নিস্তেজ ছেতিকে 'আসছি' বলতেই হাত বাড়িয়ে দেয়। ডান হাতটা বাড়িয়েই কি ভেবে সরিয়ে নেয়। পাশ থেকে বদি বলে ওঠে, "আসলে মাথার ঠিক নেই,পাগলি তো!" আমি কিন্তু নিশ্চিত সাদা মাটা ছেদি হাত বাড়াবেই। ঠিক তাই হল। সবকটা আঙুল যে হাতে আছে সেটা বাড়িয়ে দেয় আমার দিকে। তখনও মুখে হাসির রেশ।দেশ,সংবিধান,গনতন্ত্রের লেন্সে এই হাসি বুঝি ধরা পড়ে না। মাথাটার শুধু গুনতি হয়।

সূর্যের তির্যক কিরণ চার খুঁটির উপর দাঁড়িয়ে থাকা মাটির ঘরটার উপরে পাতার ছাউনিতে পড়ছে। ঘরে শুধু জলের বোতল, বালতি আর জগ ছাড়া কিছুই নজরে পড়ছে না। সত্যি এই বিরাট বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ভরা দুনিয়ায় শুধু জলও মানুষকে কত ঘণ্টা বাঁচিয়ে রাখতে পারে! রান্না হয়নি একথা মুখ ফুটে বলার দরকার হয়না। দেখে বোঝা যায় আর সেটা বোঝার পর শিখে নিতে হয় এই পৃথিবী হয়ত ছেদি হেমব্রমদের জন্য নয়। এদের শরীরটাও মাটিকে কতটা ভারবাহী করে তুলছে। মানুষ ভয় পেয়ে পালাচ্ছে পাগল ভেবে! অভাব ও অনাদর মানুষের শরীরটাকেও কত বদলে দেয়। মানুষে মানুষে অবিশ্বাসের প্রাচীর তুলে দেয়।

ফেরার মুহূর্তে বদি হেমব্রম কে বললাম- লকডাউন উঠে গেলে একবার শহরে আসুন। ছিতের চিকিৎসা দরকার। কার্ডটাও দেখা যাবে। ঘাড়ের গামছা দুই হাতে নামিয়ে এনে করজোরে ভাঙা গলায় বদি বলতে থাকলেন- "বাপ লুদুর মেয়ে ভাল হয়ে যাবে! মরা বাপটা আমার শান্তি পাবে এদ্দিনে!"

সহনাগরিক হিসেবে ছেদি হেমব্রমের কাছে মাফ চাওয়ার কোনোও ভাষা আমি খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কেমন বিস্বাদ হয়ে যাওয়া মুখ নিয়ে গুলিয়ে যাচ্ছিল শরীর। গ্রাম পেরিয়ে সামনে জনশূন্য শহুরে রাস্তা। পথ ছেড়ে ঘরে বসেছে মানুষ। আমরা সবাই বাঁচতে চাই।ছেদি হেমব্রমও।

No comments:

Post a Comment

কাথাষ্টিচ শিল্পী সোনালির লকডাউনের দিন

  কাঁথাষ্টিচ শিল্পী সোনালির লকডাউন যাপন    মেয়েদের সুন্দর মুখের নয়, সুন্দর কাজের জয়  সর্বত্র। সাফল্যের সীমানা দিগন্তপার। তাইতো সোনালীদের এত ...