Saturday 21 November 2020

মাস্কমেকার দেবযানীর লকডাউন যাপন

 দেবযানীর লকডাউনের দিন

লকডাউনে বিরাট সংখ্যক মানুষ হারিয়েছে কাজ। স্বনির্ভর প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত মহিলা দলগুলির অবস্থাও ভালো নয়। তৈরি কাজ নিয়ে ঘরে বসে দিন কাটাচ্ছে অনেকেই। এর মধ্যেই বাজিমাত করেছে দেবযানী।পাঁচ হাজারের বেশি মাস্ক বিক্রী একরকম রেকর্ড বলা যেতে পারে। আর এই অসাধ্য সাধনের কাজটি করেছে কান্দির দেবযানী ধর। মার্চ মাস থেকে এখন পর্যন্ত মাস্ক বিক্রি পেরিয়েছে পাঁচ হাজার। কাজ চালাতে সঙ্গে নিয়েছে আরও চারজন মহিলাকে। প্রিন্ট, ম্যাচিং, এক কালার,টু লেয়ার থেকে ফোর লেয়ার মাস্ক তৈরি। নানা রঙ ও ডিজাইনের বাহারি মাস্ক দেবযানী বানিয়েই চলেছে।

স্বামীর ব্যবসা হঠাৎ মন্দা। কি করবে ঘরের বৌ? নিশ্চিতভাবেই সংসারের হাল ধরবে। খুঁজবে হন্যে হয়ে একটি কাজ। দেবযানী শিক্ষিত। গ্র‍্যাজুয়েট। বিবাহ পরবর্তী জীবনে শুরু হয় অন্য লড়াই। স্বামীর প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া সোনার দোকান চালু রাখার অনেক চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় দেবযানী। তারপর চৌকাঠ পেরোনোর পালা আসে! সন্ধান চালাতে থাকে দিনরাত কাজের। অনেক কষ্টে জোগাড় হয় কাজ। তাও আবার মাসে দেড় হাজার। দুই ছেলে -মেয়ে নিয়ে বিরাট সংগ্রাম। তারপরে কাজের চাপে অসুস্থ হয় দেবযানী। আসে কোভিড ও লকডাউন। স্থানীয় বিডিওর পরামর্শেই মাস্ক বানানো শুরু করে দেবযানী। এখন চারজন মেয়ে কাজ করছে দেবযানীর কাছে। তিরিশ টাকা থেকে আশি টাকা পর্যন্ত দাম দেবযানীর মাস্কের।

 


মাস্কের সঙ্গে দেবযানীরা দিচ্ছে সুন্দর প্যাকেট। সেখানে নিজের নাম ও ফোন নাম্বার দেওয়া। এভাবেই দেবযানী খুঁজে পেতে থাকে ব্যক্তিগত ক্রেতা। বাড়তে থাকে ব্যবসার পরধি। যেমন ডিজাইন ও কালারের মাস্ক চাই তেমনটাই অর্ডার নিয়ে বানিয়ে দিচ্ছে দেবযানী।

লকডাউন আশীর্বাদ হয়ে নেমে আসে দেবযানীর জীবনে। বন্ধ সংসারের চাকায় নতুন করে গতি ফিরে এসেছে। বাঁচছে আরও চারটি পরিবার!মেয়েদের উপার্জনে পরিবারের মুখে ফুটছে হাসি! নেমে আসছে স্বস্তি।


গোকর্ণ,কান্দি,মুর্শিদাবাদ

Monday 16 November 2020

মহিলা মাইগ্রান্ট লেবারের আনলকডাউন যাপন



চম্পা-পারভিন-সরিফা-আর্জিনাদের আনলকডাউনের দিন  

মাইগ্রান্ট লেবার আর্জিনার বয়স সাতাশ। চেন্নাইয়ে নামী অন্তর্বাস কোম্পানীর কাজে হাতেখড়ি। সেখানে মাসে রোজগার ছিল সাত হাজার। তারপর ঠিকানা ছিল লুধিয়ানা। এখানে ছিল টায়ারের ফ্যাক্টরিতে কাজ। সাত মাস কাজ হতেই লকডাউনের ঘোষণা। মাস মাইনে ছিল দশ হাজার। আট মাস ধরে গ্রামে। কাজ নেই। দুটি বাচ্চা। এদের পড়ানোর জন্য টাকা উপার্জন জরুরি । কিন্তু ফেরার উপায় নেই। প্লেন ভাড়ার ক্ষমতাও নেই। ঘরে বসে কী করা যায়? ভেবেই চলেছে দিনরাত। হাতের কাছে উপায় বলতে গ্রামে এক টেলার সেলাই শেখাচ্ছে। তার কাছেই কাজ শেখার কথা ভাবছে আর্জিনা।

মাইগ্রান্ট লেবার রেখার বয়স পঁচিশ। লুধিয়ানায় স্টিল ফ্যাক্টরিতে করত কাজ। দশ মাস পরেই লকডাউন ঘোষণা। মাসে পেত সাত হাজার টাকা। তামা-পেতল আলাদা করা ছিল কাজ। ঘরে ফিরে কাজ নেই। একটিই বাচ্চা। সংসার ছোটো কিন্তু স্বামী-স্ত্রী কারও কাজ নেই। তবু সংসার চালাতে হাত পাততে হচ্ছে স্বামীর কাছেই। সেখানেও উত্তর 'নেই'। সেটা শুনেও ক্লান্তি আসছে।

সরিফা মাধ্যমিক পাশ। নাট বল্টুর কারখানায় কাজ করত লুধিয়ানায়। পেত সাত হাজার টাকা। লকডাউনে ঘরে ফেরে।এখন ফাঁকা হাত। আবার কবে কাজে ফিরবে নিশ্চয়তা নেই।

চম্পা সাইকেলের রিম তৈরির কারখান্য কাজ করত। পেত সাড়ে ছয় হাজার টাকা। ঘরে ফিরে বিরাট সমস্যা। দুই মেয়ে। সংসারে ভরসা রেশনের চাল ও বাচ্চাদের স্কুলের মিড ডে মিলের চাল-ছোলা--আলু। সংসারের হাল ফেরাতে এখন হাঁস-মুরগি পালনের কথা ভাবছে!

পারভিনার বয়স তিরিশ। নাট বলটুর কারখানায় ছিল কাজ। লকডাউনে বাড়ি ফিরে আসা। মাসে সাত হাজার টাকা পেত। এখন ঘরে বয়সে থাকা। সময় কাটছে না। অন্যদিকে অভাবও দিনে দিনে বেড়েই চলেছে।

গ্রামে মেয়েদের সামনে সেল্ফ হেল্প গ্রুপের কাজ ছিল বড় বিকল্প। এখন আটমাস ধরে তালা পড়েছে সেখানেও। এখন মহিলা মাইগ্রান্ট লেবারদের সামনে দুটি বিকল্প জীবিকা। পশুপালন ও টেলারিং। কিন্তু কোনোটিতেই স্থায়ীভাবে রোজগারের আশা নেই। কাজ নতুন করে শিখে শুরু করা কঠিন। প্রশিক্ষণের জন্য সময় দরকার।রাজ্যের বাইরের কাজ আটমাস পরে ফিরে পাওয়া অসম্ভব। ফিরে যাওয়ার উপায় আপাতত বন্ধ। তাই এরা ধুঁকছে। খাবার জুটছে কোনোরকমে কিন্তু স্বাধীনতা ও আত্মনির্ভরতার স্বাদ খুঁজে ফিরছে।

মাইগ্রান্ট লেবার সরিফা-পারভিনদের সকলের একটাই কথা- "মেয়েদের হাতে কিছু পয়সা না থাকলে সম্মান থাকে না সংসারে!" সব মেয়ের বাবারা যদি বুঝত! তবে হয়ত বিয়ের জন্য পয়সা না জমিয়ে মেয়েদের স্বনির্ভর করার জন্য অর্থ সঞ্চয় করত। বেঁচে থাকার জন্য খাদ্যের মতই সম্মান জরুরি। অসম্মানের জীবনে খাবারেও পেট ভরে না। অন্যদিকে মেয়েদের অর্থনৈতিক অধিকারের বিষয়ে অনেক বেশি করে প্রশাসনিক তৎপরতা প্রয়োজন। মহিলা মাইগ্রান্ট লেবারদের জন্য একটি নির্দিষ্ট রাষ্ট্রীয় নীতিও জরুরি। কিন্তু ভাবছে কি কেউ? নাকি এমন অবস্থা মেনে নেওয়াটাই স্বাভাবিক এমন মত প্রতিষ্ঠা হয়ে যাচ্ছে!

হরিহরপাড়া,মুর্শিদাবাদ


Sunday 8 November 2020

জুট শিল্পী লায়লার লকডাউন যাপন

 আর্টিজান লায়লার লকডাউনের দিন

প্রথম ইন্ডো আমেরিকান ভাইস প্রেসিডেন্ট মন খুশি করে দিয়েছে আমাদের। কমলা দেবি হারিস মেয়েদের আকাশে আর এক নতুন নক্ষত্র। কিন্তু এদিকে সূর্যাস্তের রঙে অনিশ্চয়তার সুর। আগামীর অন্ধকার সকালের মুখোমুখি আমাদের মেয়ে লায়লারা। বাক্সবন্দি হাতে বানানো জিনিষের ভিড়। বিক্রী নেই। মেলা নেই। কাজ করা কারিগর মেয়েদের হাতে পয়সা নেই। এদের সাহায্য নয়,শ্রমের মূল্য চাই। প্রোডাক্টের চাহিদা আছে। বাজারটাই শুধু টানা বন্ধ! তাও আট মাস ধরে চলছে বেঁচে থাকার লড়াই। লায়লার ২০ বছরের হাতের কাজের অভিজ্ঞতা। কাজ বন্ধ করলে মেয়েদের কি হবে! তাই দশজন মেয়ে করে যাচ্ছে কাজ।

লায়লা নিজে মাধ্যমিক পাশ। কিছুটা হলেও বুঝেছে কোভিডের ক্ষমতা! তারপর থেমে থাকেলে তো চলবে না! লায়লা গত বছর পুজোয় ৯০ হাজার টাকার ম্যাটের অর্ডার পেয়েছিল কলকাতায়। তারপর ছিল বিভিন্ন মেলা। তার আগেও পেয়েছিল ওয়াল টু ওয়াল কার্পেটের অর্ডার। প্রায় ৮০ হাজার টাকার। এবারে হাত শূন্য। জুটের রকমারী সম্ভার ঘরবন্দী।

লকডাউনে অনলাইন বিজনেস বুম হলেও প্রযুক্তিবিদ্যাবিহীন মেয়েরা পড়েছে বিপদে।স্মার্টফোন নেই হাতে। অনেকে আবার নিজের না থাকলেও ছেলেকে কিনে দিতে বাধ্য হয়েছে। আবার যাদের আছে তারাও খুব বেশি পারদর্শী নয়। তাই প্রান্তিক মেয়েদের ক্ষমতা নেই মোবাইল ব্যবহার করে ঘরবন্দী জিনিষের বিজ্ঞাপণ দেওয়া। এবং সেটা বিক্রীর ব্যবস্থা করা। আবার কাজে যুক্ত থাকা মেয়েদের বিপদ বেড়েছে। ট্রেন বন্ধ তাই স্বামীরাও কাজে যেতে পারেনি। প্লেনের ভাড়া দশ হাজারের বেশি। সেটা জোগাড় গ্রামের শ্রমিকদের প্রায় অসম্ভব। ছেলেমেয়ের পড়া বন্ধ। অনলাইন ক্লাস করার জন্য মোবাইলও নেই। এদিকে বিক্রী নেই তাই লায়লা এদের দিয়ে বেশি কাজ করাতেও পারছেনা। পরিবার গুলি ভুগছে। তবু এরা কেউ বসে নেই। কাজ করছে। মজুরি কম মিলছে। কেননা কাজ কম। লায়লার জিনিষ বিক্রী নেই। মেলা নেই। খুচরো বিক্রীও নেই।অর্ডার ও নেই। তবুও লায়লারা বাঁচিয়ে রেখেছে কারিগরদের ঘর। মেয়েদের সংসার। এদের শ্রমের মর্যাদা এদের উপার্জনের ন্যায্য পয়সা। তা দিয়ে চলে ঘর। লায়লারা হার মানেনি। মেয়েরাও নয়।


উদাহেরামপুর,ইসলামপুর,মুর্শিদাবাদ


Friday 6 November 2020

আদিবাসী নৃত্য শিল্পীদলের লকডাউনের দিন

আদিবাসী নৃত্য শিল্পী তপতী শকুন্তলার লকডাউন যাপন

আদিবাসী নৃত্য শিল্পী বালিকা কিস্কু,তপতী হেমব্রম,শকুন্তলা মুর্মুরা কেমন আছেন? আনলক ফেজ-৫ কি বদল করেছে দিনের  হাহাকার আর রাতের না খেয়ে শুয়ে পড়ার দিন! লকডাউন কী অভিশাপ নামিয়ে এনেছে এই মেয়েদের জীবনে!শুনলে আঁতকে উঠতে হয়। শুধু নুন দিয়ে ভাত। রেশন থেকে পাওয়া চাল। সেটাই ভরসা ছিল। ছেলেদের অনলাইন ক্লাসের জন্য  মোবাইল ফোনের আপ্রাণ চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ার গল্পবলা মায়ের চোখগুলো অন্তর বিদীর্ন করে। মনে হয় কিসের উন্নতি! কিসের গণতন্ত্র! আসলে কার জন্য এই দেশ? আদিবাসী লোকশিল্পের দলগুলির টানা বসে থাকা সাত মাস পেরিয়েছে। 'টিকমারা মারাং বুরু এনেচ সিরেঙজ গাঁওতা' ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত। ১৮ জন মহিলা নৃত্য শিল্পীদের আটজন- পূজা,অঞ্জলি,নেহা,প্রতিমারা ভাতা পায় না। কিন্তু  অনুষ্ঠানে গেছে লকডাউনের আগে। লকডাউনের প্রথম দিকে তো একবেলা খেয়ে কাটিয়েছে দিন। একঘরে প্রায় আটজন করে থাকা। 'বিষ্ণুপুর আদিবাসি লুতুতেরম গাঁওতা'র পাঁচজন নৃত্যশিল্পী শান্তি কিস্কু,রুসমি,নিশা,মামনি কিস্কুরা ভাতা ছাড়াই অনুষ্ঠান করে গেছে এতদিন। রেশনের পাওয়া চাল বেচে সংসার চালাচ্ছে!'শিয়ারা আদিবাসি হুডুর বিজলি গাঁওতা'র প্রতিষ্ঠা ২০০৭ সালে। আটজন মহিলা  নৃত্যশিল্পী শিবানী,চুমকি,মমতা,পরী,পামি মুর্মুদেরও বীনা ভাতায় চলেছে দিন। লকডাউন শুধু আধমরা করে দিয়েছে মমতা হেমব্রমদের।


কিন্তু এদের মুখের হাসি  অমলিন। নিজেদের দলের প্রোগ্রাম নিয়ে খুব উৎসাহ। অভিযোগ টাকা একসঙ্গে পায় না। সারাবছর পায় না

অন্যদিকে মাঠের কাজ মাত্র পনেরো থেকে কুড়িদিন। লকডাউনে সে আশাও ছেড়েছে। ধান কাটার সময় মাত্র ১০ দিন কাজ পাওয়ার আশা। সে টাকাও স্বামীরা মদের জন্য চুরি করে নেয়। বছরে ৩৬৫ দিন!  চলে কি করে? মেরিলা, রেখা এদের একটিই ইচ্ছা- পশুপালনের জন্য ব্যবস্থা করে দিলে সংসার বাঁচে। জীবন বাঁচে। হাস-মুরগি, ছাগল থাকলে অভাবের দিনে বিক্রী করে চলবে ঘর।

খুব সুন্দর করে সাজতে পারে প্রতিমা,অঞ্জলি,পানসুরি,শিবানীরা। দেখলে মনে হয় সৃষ্টি এর চেয়ে অপূর্ব আর কোথাও নেই! নৃত্যের কাজকে এরা দেবতার মত মানে। এরা সত্যিই বড় আর্টিস্ট। কিন্তু এদের স্বীকৃতি নেই! অভাব এদের ললাটলিখন। তাই মুখের হাসি দিয়ে জীবন জয়ের মন্ত্র আয়ত্ত করেছে আদিবাসী   নৃত্যশিল্পীরা। শুধু একটাই জিজ্ঞাসা আবার কবে প্রোগ্রাম হবে! আবার নতুন করে শিল্পীদল গড়া হবে! না খেয়ে ঘরে পড়ে থাকার  চেয়ে তো কাজ করে হাসিমুখে অভাবকে স্বীকার করে ছেলেমেয়েকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ভালো! এই মেয়ে ও মায়েদের  কাজ চাই! শুকুরমিনি,হুপনি,ফিলিচিতা মুর্মুদের কেউ আছে একটা কাজ দেওয়ার? এদের নৃত্যকে জনপ্রিয় করবে কেউ? দূর্গাপুজো,কালী পুজোর অনুষ্ঠানের দিনগুলিতে এদের ডেকে এই আদিবাসী নৃত্যশিল্পীদের শিল্পের কদর করবে  কি কেউ? আজ নয়ত আর কবে?

বিষ্ণুপুর,নবগ্রাম।

 

Wednesday 4 November 2020

কাঁথাষ্টিচ শিল্পীর বিলকিসের লকডাউন যাপন

বিলকিসের লকডাউনের দিন 

 আমাদের লক্ষ্মীরা ছড়িয়ে আছে উঠোন -দেওয়াল-ছাদ জুড়ে। কখনও বিলকিস,কখনও সোনালি কখনও মীরা নাম নিয়ে। মস্ত আকাশের নীচে এদের একার সংগ্রাম। সাত বছর বয়স থেকে সেলাই জানা বিলকিসের নিজের সেলাই প্রতিষ্ঠান ৩০ বছর পার করেছে। ফিরে দেখা ঝাপসা চোখে শুধুই মিরাকেলের ছড়াছড়ি। মেয়েদের নিয়ে কিছু করার ইচ্ছা আর আবেগ প্রায় সব ট্রফি জিতে এসে হাতে ধরিয়েছে বিলকিসের। একদম শুরুতেই প্রায় ১১ রকমের কাঁথা ষ্টিচের নাম ও সেলাই দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দেয় তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের এক অনুষ্ঠানে বিলকিস সকলকে। নিজের নামও তুলে দেয় জেলা তথ্যের ইতিহাসে। সেই সময় ১৫ হাজার টাকায় বিক্রী হয় ইতিহাসের পাতায় খুঁজে পাওয়া নানাধরণের কাঁথা স্টিচ দিয়ে তৈরি বিলকিসের শাড়ি। কিন্তু কোভিডকাল বিলকিসকে ধরাশায়ী করেছে বেশ।

রাজারহাট থেকে প্রায় ১৫ লক্ষ টাকার ষ্টিচের শাড়ি-চাদর ও পোশাক নিয়ে গাড়ি করে ঘরে ফেরা। মাত্র ৭০ হাজার টাকার বিক্রী হতেই লকডাউনের ঘোষণায় মেলা গুটিয়ে ফিরতে হয় বিলকিসকে। তবু দুশো মেয়ের সংসারের দায় মাথায় নিয়ে বিলকিসরা ধরিত্রীর লক্ষ্মীদের বুকে আগলে রেখেছে। এদের বাঁচিয়ে রাখার আরাধনায় বিলকিসরা মগ্ন। কুড়ি বছর আগে স্বামীর হঠাৎ মৃত্যুর সাতদিনের মধ্যেই মেলা যায় বিলকিস মেয়েদের নিয়ে। শোক-দুঃখ জয় করে ছোটে কর্মযজ্ঞের রথ।

উত্তরণের সূর্য প্রায় দুই যুগেরও আগে উঠেছিল। স্বামীর সঙ্গে লোন নিতে ব্যাংকে আসা বিলকিসের। সবেমাত্র কয়েক ইঞ্চি বোনা হয়েছে সোয়েটার। ব্যাংকে ভিড় দেখে চেয়ারে বসেই সোয়েটার বুনতে থাকে বিলকিস। বেলাশেষে ডাক পড়ে বিলকিসের। তখন সোয়াটারের একটা পার্ট শেষ হতে চলেছে। ম্যানেজার বিলকিসের একনিষ্ঠতা ও ধৈর্য দেখে পরামর্শ দেয় একটা সেলাই মেশিন কিনে উলের কাজ করার। ফিরতি পথে ট্রেনের কামরায় সাঁটানো এক পোষ্টার নজরে আসে। সেখানে ছিল কাটোয়ার উলের মেশিনে সোয়েটার বোনার ঠিকানা ও ফোন নাম্বার। তারপর আর পেছন ফিরে তাকানো নেই। বাজারে রেডিমেট উলের সোয়েটারের তখন খুব বেশি চল না থাকায় বিলকিসের বাড়িতে ভিড় জমায় প্রশাসনিক মানুষ থেকে ডাক্তার,অধ্যাপক,শিক্ষকরা। উলের সঙ্গে শুরু হয়ে যায় শাড়ি, চাদর ও কাঁথায় গুজরাটি,আড়ি, ব্লক,বাটিকসহ নানাধরনের ষ্টিচের কাজ। ভাগ্য খুলে যায় তন্তুজ থেকে অর্ডার পেতেই। কুড়িটি মেয়ে নিয়ে কাঁথা ও সিল্কের থানে কাজ শুরু করে বিলকিস। তারপর একের পর এক বাড়তেই থাকে কাজ। গড়ে ওঠে নিজের নামে প্রতিষ্ঠান। এখন সেখানে ২০০টি মেয়ে করছে কাজ।


আনলকডাউন ফেজ-৫ কিছু আলাদা করতে পারেনি বিলকিসদের জন্য। বিক্রী একদম বন্ধ। মেলারও ডাক নেই। কিন্তু বিলকিস মেয়েদের কাজ চালু রাখতে বদ্ধপরিকর। নিজের জমানো টাকা দিয়ে স্টক করেছে থ্রি পিস,আর্টের জন্য থান,পালাজো সেট, দোপাট্টা। স্টিচের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে মেয়েরা। সংসারটা তো বাঁচাতে হবে! সিল্কের টুকরো দিয়ে তাপ্পির চাদরের কাজও চলছে। মঞ্জুষায় সাপ্লাই দেয় বিলকিস প্রতিবার। এবারে অর্ডারের খবর নেই কোনো। প্রায় সাত মাস লকডাউনে ঘরে বসে একে একে করা মেয়েদের কাজ নিয়ে খুব গর্বিত বিলকিস। সুতো ডিজাইন সব নিজেই দিয়েছে। মেয়েরা থেমে নেই। ভাইরাস দেহে বাসা বাঁধার হুমকি দেয়। কিন্তু বিলকিসের মেয়েরা কাজের হাত চালিয়ে যাওয়ার সাহস দেখায়! লকডাউনের মধ্যে করা মেয়েদের প্রতিটি কাজের দাম অবিশ্বাস্যভাবে কম রেখেছে বিলকিস। ব্যবসা করা নয়। প্যাশন বাঁচিয়ে রাখা হয়ত একেই বলে!

বিলকিস শুধু এই দুশো মেয়ে নিয়ে আটকে পড়তে চায় না। স্বপ্ন একটি সেলাই স্কুল খোলা। অনেক বেশি মেয়েদের কাজ শেখানো ও তাদের আত্মনির্ভর করা। ঘরের এই লক্ষ্মী-দূর্গাদের সকলে চিনল কই!


সালার,মুর্শিদাবাদ

Tuesday 3 November 2020

ব্যাগ নির্মাতা ডলি রায়ের লম ডাউনের দিন

 ব্যাগ নির্মাতা ডলি রায়ের লকডাউন যাপন

ভাইরাস মুক্ত পৃথিবী  নাগালে এসে যাবে! হয়ত অপেক্ষা আরও কিছুদিন। এক কঠিন আর্থিক পরিস্থিতির সঙ্গে লড়ছে মহিলা উদ্যোক্তারা। প্রায় যুদ্ধকালীন অবস্থার মোকাবিলায় নেমেছেন তারা। এন্ট্রেপ্রেনার দের সঙ্গে যুক্ত পরিবারগুলি  ধুঁকছে!৩৫  বছরের সমৃদ্ধ ব্যাগ প্রতিষ্ঠান ডলি ও দিলীপ রায়ের। দীর্ঘ নয় মাস ধরে কোনো অর্ডার নেই। কতদিন এভাবে চলবে কেউ জানেনা!  মুখ ধুবড়ে পড়েছে পরিকাঠামো। মনোবল হারিয়েছে ডলির মেয়েরা। 

বিয়ের পরেই স্বামীর  সংস্থা  সামলানোর দায়িত্ব এসে পড়ে ডলির উপর। একশোর বেশি মেয়েকে নিয়ে চলতে থাকে কাঁথা স্টিচের ব্যাগের কাজ। ভারতের সর্বত্র এই ব্যাগের চালান ছিল রমরমিয়ে। এখন প্রতিদিন মেয়েরা কাজ শুরু কবে জিজ্ঞাসায় কড়া নাড়ছে। ডলিও মানসিক ভাবে কিছুটা বিপর্যস্ত। উত্তর নেই কোনো কবে থেকে আসলে কাজ শুরু!

ঘরের প্রোডাক্ট বন্ধ অবস্থায় পড়ে। ডলিদির স্বামী একদা নিজের প্রোডাকশনের দেশব্যাপী মার্কেটিং করেছেন। তিনিও কিছুটা ক্লান্ত! অসহায় জিজ্ঞাসা কবে ঠিক হতে পারে অবস্থা! অর্ডার আবার কবে আসতে শুরু করবে!  ডলিদিও কার্যত হতাশ। ডলিদি জানায় ২০০০ সালে বন্যার সময় বস্তা বস্তা সিল্কের কাপড় ফেলতে হয়েছিল তবুও এমন পরিস্থিতি হয়নি।  লকডাউন একেবারে উদ্যোক্তাদের মেরুদন্ডে আঘাত। উঠে দাঁড়ানো দিনের পর দিন কঠিন হয়ে উঠছে।

রীতিমতো সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ীরাও মুখ আড়াল করছেন। সংকট এতটাই তীব্র। ডলিদির ব্যাগ অসাধারণ। খুব আকর্ষনীয়। মেয়েদের পরিশ্রম ও মনোযোগের স্পষ্ট ছাপ রয়েছে। ডলিদির কাছে প্রাথমিক কাজ শেষ করার পর তা স্বামীর কারখানায় পৌছায়। সেখানেও মহিলারা পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে। ডলিদি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলেন,"কটেজ ইন্ডাস্ট্রি  দেশের বড় ভবিষ্যৎ। মহিলা উদ্যোক্তা দের জন্য আলাদা করে ভাবনার দরকার আছে তো!"এটাও সত্য  ন্যাচারাল কালামিটি বা অন্যান্য দূর্যোগ  পরিস্থিতিতে  মহিলা উদ্যোক্তাদের জন্য আলাদা স্কিম থাকা দরকার। ফান্ড ড্রাই এর  মোকাবিলায় সরকার হাত না বাড়ালে মেয়েরা কোথায় দাঁড়াবে! সরকারি লোনের ক্ষেত্রেও তো সাড়ে বারো শতাংশ ইন্টারেস্ট প্রাথমিকভাবে গুনতে হয় মেয়েদের। ডলিদির কথার প্রতিফলন সরাসরি মেলে বাস্তব পরিস্থিতিতে। মহিলা-প্রতিষ্ঠিত স্টার্টআপস বা কোফাউন্ডার  মহিলাদের  স্টার্টআপসের পরিমাণ ভারতীয় স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমের মোট বিনিয়োগের ৬ শতাংশেরও কম।

"vocal for local" সাপোর্ট করতে গেলেও ক্রয়ক্ষমতা চাই! কোভিডের কারণে ক্রেতাদের পছন্দ এখন এসেন্সিয়াল ও নন এসেন্সিয়াল দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। গ্লোবালি ৯৩% ক্রেতা মনে করছে ব্রান্ডের নন এসেন্সিয়াল স্টোর বন্ধ করা দরকার। ইতালী, স্পেনে তা অলরেডি হয়েছে।  ডলিদিদের সমস্যা দিন দিন জটিল হচ্ছে। লাক্সারি গুডসের  চাহিদা না থাকলে উৎপাদন কি করে হবে? উৎপাদন না হলে জুড়ে থাকা মহিলা কর্মীদের ঘর কী করে চলবে?

kandi,berhampore

কাথাষ্টিচ শিল্পী সোনালির লকডাউনের দিন

  কাঁথাষ্টিচ শিল্পী সোনালির লকডাউন যাপন    মেয়েদের সুন্দর মুখের নয়, সুন্দর কাজের জয়  সর্বত্র। সাফল্যের সীমানা দিগন্তপার। তাইতো সোনালীদের এত ...