Saturday 5 December 2020

কাথাষ্টিচ শিল্পী সোনালির লকডাউনের দিন

 কাঁথাষ্টিচ শিল্পী সোনালির লকডাউন যাপন 

 মেয়েদের সুন্দর মুখের নয়, সুন্দর কাজের জয়  সর্বত্র। সাফল্যের সীমানা দিগন্তপার। তাইতো সোনালীদের এত ঝকঝকে হাসি। পরিচ্ছন্ন মুখ। কাজ সুন্দর হয়। তাইতো মুখশ্রী মন জয় করে নেয়। ব্যক্তিত্ব নজর কাড়ে। মুর্শিদাবাদের সোনালীর গল্প সেইরকম। সফল ব্যবসায়ী,সফল মা। ছেলে ব্যাঙ্গালোরে আই টি কর্মী। দীর্ঘ দশ বছর ধরে নিজের হাতেই ষ্টিচ ও ডিজাইনার শাড়ির ব্যবসা সামলানো। নিজের ডিজাইনিং কোর্সও কলকাতা থেকে করে আসা। সেখানেও নিজের ব্যবসা প্রমোট করা। সবটাই সোনালীর নিজের ক্ষমতা ও চেষ্টায়। 

লকডাউনে সেল জিরো। বিশ্ববাংলার হাটে মেলা শুরু।  আবার জেলায় জেলায় মেলার প্রস্তুতি হবে হয়ত। কিন্তু সোনালীরা থেমে থাকেনি। মুর্শিদাবাদের বহরমপুরেই 'সোনাঝুড়ির হাট' নামিয়ে আনছে তারা। নিজেরাই বসে না থেকে উদ্যোগ নিতে চলেছে। 

সোনালীর গুজরাটি ও কাশ্মিরি  ষ্টিচের শাড়ি মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতায় শুধু গেছে তা নয়।  আমেরিকায় পাড়ি দিয়েছে। গেছে দেড়শো গুজরাটি কাজের চাদর ও শাড়ি । খুব প্রশংসিত হয়েছে তার হাতের কাজের শাড়ি। পঁয়ত্রিশ জন মেয়ে  কাজ করে সোনালীর কাছে। মেয়েদের জন্য লকডাউনে চালু রেখেছিল সোনালী কাজ। এবার আশার আলো। মেলা তো শুরু। সেলের খাতায় নয় মাস পর অংক বসানোর পালা! সোনালীদের দক্ষতা নিয়ে বলার মানুষ কম। দেশ পেরিয়ে সুদূর আমেরিকার মাটি জয় করছে সোনালীর ডিজাইন করা  শাড়ি!  মুর্শিদাবাদের এই সফল মহিলাকে না জানলে,না চিনলে নবাবের দেশকে আর কী চেনা!

বহরমপুর,মুর্শিদাবাদ

Wednesday 2 December 2020

কাঁথা শিল্পী মিলির লকডাউন যাপন

 মিলি খাতুনের লকডাউনের দিন

শিল্পীর সবচেয়ে বড় বিপন্নতা কাজ না করতে পারা। লকডাউনের দিন মিলিরা একরকম দিশেহারা হয়ে পড়ে। চৌদ্দ বছরের প্রতিষ্ঠান মিলির। নাগাড়ে বন্ধ । মিলির কাছে কাজ করে ১৪৫ জন মেয়ে।তাদের পরিবারের দিকে তাকিয়ে মিলি চালিয়ে যেতে থাকে কাজ। ওদের মুখে হাসি ফোটাতে গিয়ে মিলির আর্থিক অবস্থা খারাপ হতে থাকে ।ব্যাংক থেকে লোন করতে হয় । নিজের শখের গয়না জমা দিয়েই তারপর  আসে টাকা। 

তিনটি প্রজন্ম শিল্পী। প্রথমে হাতের কাজ ছিল পারিবারিক। তারপর মিলির মা কাজকে বাজার পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে। মিলি বারো বছর বয়সে জড়িয়ে পড়ে কাজে। তারপর কাজ বাড়তেই থাকে। মহিলা-পুরুষের সমস্ত রকম পোশাক,ব্যাগ এবং ফাইল, বিছানার চাদর,কুশান সবকিছুতেই কাঁথার কাজ করার আইডিয়া নিয়ে এগিয়ে যায় মিলি। ধীরে ধীরে মেয়েদের সংখ্যা বাড়তে থাকে।

মিলির কাজ চলতে থাকে সব প্রতিকূলতা অতিক্রম করে। ব্যক্তিগত লোনের ভার মাথায়  নিয়েও মেয়েদের কাজ চালিয়ে যায় মিলি। মেলার ভরসায় থাকতে থাকতে অবশেষের দীর্ঘ  দশ মাস পরে সুদিন আসে। বীরভূমের শিল্পী হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া মিলি আসলে অন্যের ঘরে আলো জ্বালতে গিয়ে নিজেই প্রদীপের অন্ধকারে এসে পড়ে। তবু ক্ষেদ নেই।  সকলকে নিয়েই প্রতিষ্ঠানের গর্ব বহাল। নিজেই ডিজাইন করে। সুতো ঠিক করে দেয়। তারপর মেয়েদের শিখিয়ে দক্ষ তৈরি করে নেয়। প্রতিনিয়ত মেয়েদের খোঁজ চলতে থাকে। তাদের উপযুক্ত পারিশ্রমিক দিয়ে গড়ে-পিটে নিয়ে ভালো কাজ উপহার দেওয়ার এক নেশা মিলিকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। ব্যবসা  শুধু নয়,মেয়েদের  সম্মানজনক উপায়ে রোজগারের মধ্যে নিয়ে আসা মিলির লক্ষ্য। এবং কাজের সূক্ষ্মতা ও সৌন্দর্য তার প্রথম লক্ষ্য। সেখানে কোনোরকম সমঝোতার জায়গা নেই। 

হাসিমুখে পাড়ি দিয়েছে মিলি কলকাতার ইকো পার্কের মেলায়। লকডাউনের পর মিলির এবার দ্বিতীয়  মেলায় যোগদান। মাথায় ঋণের বোঝা। তবু মেয়েদের লকডাউনের মধ্যে মেয়েদের হাতের তৈরি জিনিষ বিক্রী করতেই হবে! ক্রেতাদের দিতে হবে নতুন ডিজাইনের উন্নত মানের জিনিষ। লকডাউনের বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রামে প্রতিষ্ঠানের মেয়েরাই ছিল একমাত্র সাথী। তাদের জন্যই মিলির দৌড় চলছেই। তবু কিঞ্চিৎ হতাশা। মহিলা ব্যবসায়ীদের প্রতি সরকার যদি আর একটু সদয় হোত। তবে এই লড়াই বুঝি একটু সহজ হয়ে যেত। এতবড় বিপদ তো একেবারেই প্রথম দেখা! 

বীরভূম।


Saturday 21 November 2020

মাস্কমেকার দেবযানীর লকডাউন যাপন

 দেবযানীর লকডাউনের দিন

লকডাউনে বিরাট সংখ্যক মানুষ হারিয়েছে কাজ। স্বনির্ভর প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত মহিলা দলগুলির অবস্থাও ভালো নয়। তৈরি কাজ নিয়ে ঘরে বসে দিন কাটাচ্ছে অনেকেই। এর মধ্যেই বাজিমাত করেছে দেবযানী।পাঁচ হাজারের বেশি মাস্ক বিক্রী একরকম রেকর্ড বলা যেতে পারে। আর এই অসাধ্য সাধনের কাজটি করেছে কান্দির দেবযানী ধর। মার্চ মাস থেকে এখন পর্যন্ত মাস্ক বিক্রি পেরিয়েছে পাঁচ হাজার। কাজ চালাতে সঙ্গে নিয়েছে আরও চারজন মহিলাকে। প্রিন্ট, ম্যাচিং, এক কালার,টু লেয়ার থেকে ফোর লেয়ার মাস্ক তৈরি। নানা রঙ ও ডিজাইনের বাহারি মাস্ক দেবযানী বানিয়েই চলেছে।

স্বামীর ব্যবসা হঠাৎ মন্দা। কি করবে ঘরের বৌ? নিশ্চিতভাবেই সংসারের হাল ধরবে। খুঁজবে হন্যে হয়ে একটি কাজ। দেবযানী শিক্ষিত। গ্র‍্যাজুয়েট। বিবাহ পরবর্তী জীবনে শুরু হয় অন্য লড়াই। স্বামীর প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া সোনার দোকান চালু রাখার অনেক চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় দেবযানী। তারপর চৌকাঠ পেরোনোর পালা আসে! সন্ধান চালাতে থাকে দিনরাত কাজের। অনেক কষ্টে জোগাড় হয় কাজ। তাও আবার মাসে দেড় হাজার। দুই ছেলে -মেয়ে নিয়ে বিরাট সংগ্রাম। তারপরে কাজের চাপে অসুস্থ হয় দেবযানী। আসে কোভিড ও লকডাউন। স্থানীয় বিডিওর পরামর্শেই মাস্ক বানানো শুরু করে দেবযানী। এখন চারজন মেয়ে কাজ করছে দেবযানীর কাছে। তিরিশ টাকা থেকে আশি টাকা পর্যন্ত দাম দেবযানীর মাস্কের।

 


মাস্কের সঙ্গে দেবযানীরা দিচ্ছে সুন্দর প্যাকেট। সেখানে নিজের নাম ও ফোন নাম্বার দেওয়া। এভাবেই দেবযানী খুঁজে পেতে থাকে ব্যক্তিগত ক্রেতা। বাড়তে থাকে ব্যবসার পরধি। যেমন ডিজাইন ও কালারের মাস্ক চাই তেমনটাই অর্ডার নিয়ে বানিয়ে দিচ্ছে দেবযানী।

লকডাউন আশীর্বাদ হয়ে নেমে আসে দেবযানীর জীবনে। বন্ধ সংসারের চাকায় নতুন করে গতি ফিরে এসেছে। বাঁচছে আরও চারটি পরিবার!মেয়েদের উপার্জনে পরিবারের মুখে ফুটছে হাসি! নেমে আসছে স্বস্তি।


গোকর্ণ,কান্দি,মুর্শিদাবাদ

Monday 16 November 2020

মহিলা মাইগ্রান্ট লেবারের আনলকডাউন যাপন



চম্পা-পারভিন-সরিফা-আর্জিনাদের আনলকডাউনের দিন  

মাইগ্রান্ট লেবার আর্জিনার বয়স সাতাশ। চেন্নাইয়ে নামী অন্তর্বাস কোম্পানীর কাজে হাতেখড়ি। সেখানে মাসে রোজগার ছিল সাত হাজার। তারপর ঠিকানা ছিল লুধিয়ানা। এখানে ছিল টায়ারের ফ্যাক্টরিতে কাজ। সাত মাস কাজ হতেই লকডাউনের ঘোষণা। মাস মাইনে ছিল দশ হাজার। আট মাস ধরে গ্রামে। কাজ নেই। দুটি বাচ্চা। এদের পড়ানোর জন্য টাকা উপার্জন জরুরি । কিন্তু ফেরার উপায় নেই। প্লেন ভাড়ার ক্ষমতাও নেই। ঘরে বসে কী করা যায়? ভেবেই চলেছে দিনরাত। হাতের কাছে উপায় বলতে গ্রামে এক টেলার সেলাই শেখাচ্ছে। তার কাছেই কাজ শেখার কথা ভাবছে আর্জিনা।

মাইগ্রান্ট লেবার রেখার বয়স পঁচিশ। লুধিয়ানায় স্টিল ফ্যাক্টরিতে করত কাজ। দশ মাস পরেই লকডাউন ঘোষণা। মাসে পেত সাত হাজার টাকা। তামা-পেতল আলাদা করা ছিল কাজ। ঘরে ফিরে কাজ নেই। একটিই বাচ্চা। সংসার ছোটো কিন্তু স্বামী-স্ত্রী কারও কাজ নেই। তবু সংসার চালাতে হাত পাততে হচ্ছে স্বামীর কাছেই। সেখানেও উত্তর 'নেই'। সেটা শুনেও ক্লান্তি আসছে।

সরিফা মাধ্যমিক পাশ। নাট বল্টুর কারখানায় কাজ করত লুধিয়ানায়। পেত সাত হাজার টাকা। লকডাউনে ঘরে ফেরে।এখন ফাঁকা হাত। আবার কবে কাজে ফিরবে নিশ্চয়তা নেই।

চম্পা সাইকেলের রিম তৈরির কারখান্য কাজ করত। পেত সাড়ে ছয় হাজার টাকা। ঘরে ফিরে বিরাট সমস্যা। দুই মেয়ে। সংসারে ভরসা রেশনের চাল ও বাচ্চাদের স্কুলের মিড ডে মিলের চাল-ছোলা--আলু। সংসারের হাল ফেরাতে এখন হাঁস-মুরগি পালনের কথা ভাবছে!

পারভিনার বয়স তিরিশ। নাট বলটুর কারখানায় ছিল কাজ। লকডাউনে বাড়ি ফিরে আসা। মাসে সাত হাজার টাকা পেত। এখন ঘরে বয়সে থাকা। সময় কাটছে না। অন্যদিকে অভাবও দিনে দিনে বেড়েই চলেছে।

গ্রামে মেয়েদের সামনে সেল্ফ হেল্প গ্রুপের কাজ ছিল বড় বিকল্প। এখন আটমাস ধরে তালা পড়েছে সেখানেও। এখন মহিলা মাইগ্রান্ট লেবারদের সামনে দুটি বিকল্প জীবিকা। পশুপালন ও টেলারিং। কিন্তু কোনোটিতেই স্থায়ীভাবে রোজগারের আশা নেই। কাজ নতুন করে শিখে শুরু করা কঠিন। প্রশিক্ষণের জন্য সময় দরকার।রাজ্যের বাইরের কাজ আটমাস পরে ফিরে পাওয়া অসম্ভব। ফিরে যাওয়ার উপায় আপাতত বন্ধ। তাই এরা ধুঁকছে। খাবার জুটছে কোনোরকমে কিন্তু স্বাধীনতা ও আত্মনির্ভরতার স্বাদ খুঁজে ফিরছে।

মাইগ্রান্ট লেবার সরিফা-পারভিনদের সকলের একটাই কথা- "মেয়েদের হাতে কিছু পয়সা না থাকলে সম্মান থাকে না সংসারে!" সব মেয়ের বাবারা যদি বুঝত! তবে হয়ত বিয়ের জন্য পয়সা না জমিয়ে মেয়েদের স্বনির্ভর করার জন্য অর্থ সঞ্চয় করত। বেঁচে থাকার জন্য খাদ্যের মতই সম্মান জরুরি। অসম্মানের জীবনে খাবারেও পেট ভরে না। অন্যদিকে মেয়েদের অর্থনৈতিক অধিকারের বিষয়ে অনেক বেশি করে প্রশাসনিক তৎপরতা প্রয়োজন। মহিলা মাইগ্রান্ট লেবারদের জন্য একটি নির্দিষ্ট রাষ্ট্রীয় নীতিও জরুরি। কিন্তু ভাবছে কি কেউ? নাকি এমন অবস্থা মেনে নেওয়াটাই স্বাভাবিক এমন মত প্রতিষ্ঠা হয়ে যাচ্ছে!

হরিহরপাড়া,মুর্শিদাবাদ


Sunday 8 November 2020

জুট শিল্পী লায়লার লকডাউন যাপন

 আর্টিজান লায়লার লকডাউনের দিন

প্রথম ইন্ডো আমেরিকান ভাইস প্রেসিডেন্ট মন খুশি করে দিয়েছে আমাদের। কমলা দেবি হারিস মেয়েদের আকাশে আর এক নতুন নক্ষত্র। কিন্তু এদিকে সূর্যাস্তের রঙে অনিশ্চয়তার সুর। আগামীর অন্ধকার সকালের মুখোমুখি আমাদের মেয়ে লায়লারা। বাক্সবন্দি হাতে বানানো জিনিষের ভিড়। বিক্রী নেই। মেলা নেই। কাজ করা কারিগর মেয়েদের হাতে পয়সা নেই। এদের সাহায্য নয়,শ্রমের মূল্য চাই। প্রোডাক্টের চাহিদা আছে। বাজারটাই শুধু টানা বন্ধ! তাও আট মাস ধরে চলছে বেঁচে থাকার লড়াই। লায়লার ২০ বছরের হাতের কাজের অভিজ্ঞতা। কাজ বন্ধ করলে মেয়েদের কি হবে! তাই দশজন মেয়ে করে যাচ্ছে কাজ।

লায়লা নিজে মাধ্যমিক পাশ। কিছুটা হলেও বুঝেছে কোভিডের ক্ষমতা! তারপর থেমে থাকেলে তো চলবে না! লায়লা গত বছর পুজোয় ৯০ হাজার টাকার ম্যাটের অর্ডার পেয়েছিল কলকাতায়। তারপর ছিল বিভিন্ন মেলা। তার আগেও পেয়েছিল ওয়াল টু ওয়াল কার্পেটের অর্ডার। প্রায় ৮০ হাজার টাকার। এবারে হাত শূন্য। জুটের রকমারী সম্ভার ঘরবন্দী।

লকডাউনে অনলাইন বিজনেস বুম হলেও প্রযুক্তিবিদ্যাবিহীন মেয়েরা পড়েছে বিপদে।স্মার্টফোন নেই হাতে। অনেকে আবার নিজের না থাকলেও ছেলেকে কিনে দিতে বাধ্য হয়েছে। আবার যাদের আছে তারাও খুব বেশি পারদর্শী নয়। তাই প্রান্তিক মেয়েদের ক্ষমতা নেই মোবাইল ব্যবহার করে ঘরবন্দী জিনিষের বিজ্ঞাপণ দেওয়া। এবং সেটা বিক্রীর ব্যবস্থা করা। আবার কাজে যুক্ত থাকা মেয়েদের বিপদ বেড়েছে। ট্রেন বন্ধ তাই স্বামীরাও কাজে যেতে পারেনি। প্লেনের ভাড়া দশ হাজারের বেশি। সেটা জোগাড় গ্রামের শ্রমিকদের প্রায় অসম্ভব। ছেলেমেয়ের পড়া বন্ধ। অনলাইন ক্লাস করার জন্য মোবাইলও নেই। এদিকে বিক্রী নেই তাই লায়লা এদের দিয়ে বেশি কাজ করাতেও পারছেনা। পরিবার গুলি ভুগছে। তবু এরা কেউ বসে নেই। কাজ করছে। মজুরি কম মিলছে। কেননা কাজ কম। লায়লার জিনিষ বিক্রী নেই। মেলা নেই। খুচরো বিক্রীও নেই।অর্ডার ও নেই। তবুও লায়লারা বাঁচিয়ে রেখেছে কারিগরদের ঘর। মেয়েদের সংসার। এদের শ্রমের মর্যাদা এদের উপার্জনের ন্যায্য পয়সা। তা দিয়ে চলে ঘর। লায়লারা হার মানেনি। মেয়েরাও নয়।


উদাহেরামপুর,ইসলামপুর,মুর্শিদাবাদ


Friday 6 November 2020

আদিবাসী নৃত্য শিল্পীদলের লকডাউনের দিন

আদিবাসী নৃত্য শিল্পী তপতী শকুন্তলার লকডাউন যাপন

আদিবাসী নৃত্য শিল্পী বালিকা কিস্কু,তপতী হেমব্রম,শকুন্তলা মুর্মুরা কেমন আছেন? আনলক ফেজ-৫ কি বদল করেছে দিনের  হাহাকার আর রাতের না খেয়ে শুয়ে পড়ার দিন! লকডাউন কী অভিশাপ নামিয়ে এনেছে এই মেয়েদের জীবনে!শুনলে আঁতকে উঠতে হয়। শুধু নুন দিয়ে ভাত। রেশন থেকে পাওয়া চাল। সেটাই ভরসা ছিল। ছেলেদের অনলাইন ক্লাসের জন্য  মোবাইল ফোনের আপ্রাণ চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ার গল্পবলা মায়ের চোখগুলো অন্তর বিদীর্ন করে। মনে হয় কিসের উন্নতি! কিসের গণতন্ত্র! আসলে কার জন্য এই দেশ? আদিবাসী লোকশিল্পের দলগুলির টানা বসে থাকা সাত মাস পেরিয়েছে। 'টিকমারা মারাং বুরু এনেচ সিরেঙজ গাঁওতা' ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত। ১৮ জন মহিলা নৃত্য শিল্পীদের আটজন- পূজা,অঞ্জলি,নেহা,প্রতিমারা ভাতা পায় না। কিন্তু  অনুষ্ঠানে গেছে লকডাউনের আগে। লকডাউনের প্রথম দিকে তো একবেলা খেয়ে কাটিয়েছে দিন। একঘরে প্রায় আটজন করে থাকা। 'বিষ্ণুপুর আদিবাসি লুতুতেরম গাঁওতা'র পাঁচজন নৃত্যশিল্পী শান্তি কিস্কু,রুসমি,নিশা,মামনি কিস্কুরা ভাতা ছাড়াই অনুষ্ঠান করে গেছে এতদিন। রেশনের পাওয়া চাল বেচে সংসার চালাচ্ছে!'শিয়ারা আদিবাসি হুডুর বিজলি গাঁওতা'র প্রতিষ্ঠা ২০০৭ সালে। আটজন মহিলা  নৃত্যশিল্পী শিবানী,চুমকি,মমতা,পরী,পামি মুর্মুদেরও বীনা ভাতায় চলেছে দিন। লকডাউন শুধু আধমরা করে দিয়েছে মমতা হেমব্রমদের।


কিন্তু এদের মুখের হাসি  অমলিন। নিজেদের দলের প্রোগ্রাম নিয়ে খুব উৎসাহ। অভিযোগ টাকা একসঙ্গে পায় না। সারাবছর পায় না

অন্যদিকে মাঠের কাজ মাত্র পনেরো থেকে কুড়িদিন। লকডাউনে সে আশাও ছেড়েছে। ধান কাটার সময় মাত্র ১০ দিন কাজ পাওয়ার আশা। সে টাকাও স্বামীরা মদের জন্য চুরি করে নেয়। বছরে ৩৬৫ দিন!  চলে কি করে? মেরিলা, রেখা এদের একটিই ইচ্ছা- পশুপালনের জন্য ব্যবস্থা করে দিলে সংসার বাঁচে। জীবন বাঁচে। হাস-মুরগি, ছাগল থাকলে অভাবের দিনে বিক্রী করে চলবে ঘর।

খুব সুন্দর করে সাজতে পারে প্রতিমা,অঞ্জলি,পানসুরি,শিবানীরা। দেখলে মনে হয় সৃষ্টি এর চেয়ে অপূর্ব আর কোথাও নেই! নৃত্যের কাজকে এরা দেবতার মত মানে। এরা সত্যিই বড় আর্টিস্ট। কিন্তু এদের স্বীকৃতি নেই! অভাব এদের ললাটলিখন। তাই মুখের হাসি দিয়ে জীবন জয়ের মন্ত্র আয়ত্ত করেছে আদিবাসী   নৃত্যশিল্পীরা। শুধু একটাই জিজ্ঞাসা আবার কবে প্রোগ্রাম হবে! আবার নতুন করে শিল্পীদল গড়া হবে! না খেয়ে ঘরে পড়ে থাকার  চেয়ে তো কাজ করে হাসিমুখে অভাবকে স্বীকার করে ছেলেমেয়েকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ভালো! এই মেয়ে ও মায়েদের  কাজ চাই! শুকুরমিনি,হুপনি,ফিলিচিতা মুর্মুদের কেউ আছে একটা কাজ দেওয়ার? এদের নৃত্যকে জনপ্রিয় করবে কেউ? দূর্গাপুজো,কালী পুজোর অনুষ্ঠানের দিনগুলিতে এদের ডেকে এই আদিবাসী নৃত্যশিল্পীদের শিল্পের কদর করবে  কি কেউ? আজ নয়ত আর কবে?

বিষ্ণুপুর,নবগ্রাম।

 

Wednesday 4 November 2020

কাঁথাষ্টিচ শিল্পীর বিলকিসের লকডাউন যাপন

বিলকিসের লকডাউনের দিন 

 আমাদের লক্ষ্মীরা ছড়িয়ে আছে উঠোন -দেওয়াল-ছাদ জুড়ে। কখনও বিলকিস,কখনও সোনালি কখনও মীরা নাম নিয়ে। মস্ত আকাশের নীচে এদের একার সংগ্রাম। সাত বছর বয়স থেকে সেলাই জানা বিলকিসের নিজের সেলাই প্রতিষ্ঠান ৩০ বছর পার করেছে। ফিরে দেখা ঝাপসা চোখে শুধুই মিরাকেলের ছড়াছড়ি। মেয়েদের নিয়ে কিছু করার ইচ্ছা আর আবেগ প্রায় সব ট্রফি জিতে এসে হাতে ধরিয়েছে বিলকিসের। একদম শুরুতেই প্রায় ১১ রকমের কাঁথা ষ্টিচের নাম ও সেলাই দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দেয় তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের এক অনুষ্ঠানে বিলকিস সকলকে। নিজের নামও তুলে দেয় জেলা তথ্যের ইতিহাসে। সেই সময় ১৫ হাজার টাকায় বিক্রী হয় ইতিহাসের পাতায় খুঁজে পাওয়া নানাধরণের কাঁথা স্টিচ দিয়ে তৈরি বিলকিসের শাড়ি। কিন্তু কোভিডকাল বিলকিসকে ধরাশায়ী করেছে বেশ।

রাজারহাট থেকে প্রায় ১৫ লক্ষ টাকার ষ্টিচের শাড়ি-চাদর ও পোশাক নিয়ে গাড়ি করে ঘরে ফেরা। মাত্র ৭০ হাজার টাকার বিক্রী হতেই লকডাউনের ঘোষণায় মেলা গুটিয়ে ফিরতে হয় বিলকিসকে। তবু দুশো মেয়ের সংসারের দায় মাথায় নিয়ে বিলকিসরা ধরিত্রীর লক্ষ্মীদের বুকে আগলে রেখেছে। এদের বাঁচিয়ে রাখার আরাধনায় বিলকিসরা মগ্ন। কুড়ি বছর আগে স্বামীর হঠাৎ মৃত্যুর সাতদিনের মধ্যেই মেলা যায় বিলকিস মেয়েদের নিয়ে। শোক-দুঃখ জয় করে ছোটে কর্মযজ্ঞের রথ।

উত্তরণের সূর্য প্রায় দুই যুগেরও আগে উঠেছিল। স্বামীর সঙ্গে লোন নিতে ব্যাংকে আসা বিলকিসের। সবেমাত্র কয়েক ইঞ্চি বোনা হয়েছে সোয়েটার। ব্যাংকে ভিড় দেখে চেয়ারে বসেই সোয়েটার বুনতে থাকে বিলকিস। বেলাশেষে ডাক পড়ে বিলকিসের। তখন সোয়াটারের একটা পার্ট শেষ হতে চলেছে। ম্যানেজার বিলকিসের একনিষ্ঠতা ও ধৈর্য দেখে পরামর্শ দেয় একটা সেলাই মেশিন কিনে উলের কাজ করার। ফিরতি পথে ট্রেনের কামরায় সাঁটানো এক পোষ্টার নজরে আসে। সেখানে ছিল কাটোয়ার উলের মেশিনে সোয়েটার বোনার ঠিকানা ও ফোন নাম্বার। তারপর আর পেছন ফিরে তাকানো নেই। বাজারে রেডিমেট উলের সোয়েটারের তখন খুব বেশি চল না থাকায় বিলকিসের বাড়িতে ভিড় জমায় প্রশাসনিক মানুষ থেকে ডাক্তার,অধ্যাপক,শিক্ষকরা। উলের সঙ্গে শুরু হয়ে যায় শাড়ি, চাদর ও কাঁথায় গুজরাটি,আড়ি, ব্লক,বাটিকসহ নানাধরনের ষ্টিচের কাজ। ভাগ্য খুলে যায় তন্তুজ থেকে অর্ডার পেতেই। কুড়িটি মেয়ে নিয়ে কাঁথা ও সিল্কের থানে কাজ শুরু করে বিলকিস। তারপর একের পর এক বাড়তেই থাকে কাজ। গড়ে ওঠে নিজের নামে প্রতিষ্ঠান। এখন সেখানে ২০০টি মেয়ে করছে কাজ।


আনলকডাউন ফেজ-৫ কিছু আলাদা করতে পারেনি বিলকিসদের জন্য। বিক্রী একদম বন্ধ। মেলারও ডাক নেই। কিন্তু বিলকিস মেয়েদের কাজ চালু রাখতে বদ্ধপরিকর। নিজের জমানো টাকা দিয়ে স্টক করেছে থ্রি পিস,আর্টের জন্য থান,পালাজো সেট, দোপাট্টা। স্টিচের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে মেয়েরা। সংসারটা তো বাঁচাতে হবে! সিল্কের টুকরো দিয়ে তাপ্পির চাদরের কাজও চলছে। মঞ্জুষায় সাপ্লাই দেয় বিলকিস প্রতিবার। এবারে অর্ডারের খবর নেই কোনো। প্রায় সাত মাস লকডাউনে ঘরে বসে একে একে করা মেয়েদের কাজ নিয়ে খুব গর্বিত বিলকিস। সুতো ডিজাইন সব নিজেই দিয়েছে। মেয়েরা থেমে নেই। ভাইরাস দেহে বাসা বাঁধার হুমকি দেয়। কিন্তু বিলকিসের মেয়েরা কাজের হাত চালিয়ে যাওয়ার সাহস দেখায়! লকডাউনের মধ্যে করা মেয়েদের প্রতিটি কাজের দাম অবিশ্বাস্যভাবে কম রেখেছে বিলকিস। ব্যবসা করা নয়। প্যাশন বাঁচিয়ে রাখা হয়ত একেই বলে!

বিলকিস শুধু এই দুশো মেয়ে নিয়ে আটকে পড়তে চায় না। স্বপ্ন একটি সেলাই স্কুল খোলা। অনেক বেশি মেয়েদের কাজ শেখানো ও তাদের আত্মনির্ভর করা। ঘরের এই লক্ষ্মী-দূর্গাদের সকলে চিনল কই!


সালার,মুর্শিদাবাদ

Tuesday 3 November 2020

ব্যাগ নির্মাতা ডলি রায়ের লম ডাউনের দিন

 ব্যাগ নির্মাতা ডলি রায়ের লকডাউন যাপন

ভাইরাস মুক্ত পৃথিবী  নাগালে এসে যাবে! হয়ত অপেক্ষা আরও কিছুদিন। এক কঠিন আর্থিক পরিস্থিতির সঙ্গে লড়ছে মহিলা উদ্যোক্তারা। প্রায় যুদ্ধকালীন অবস্থার মোকাবিলায় নেমেছেন তারা। এন্ট্রেপ্রেনার দের সঙ্গে যুক্ত পরিবারগুলি  ধুঁকছে!৩৫  বছরের সমৃদ্ধ ব্যাগ প্রতিষ্ঠান ডলি ও দিলীপ রায়ের। দীর্ঘ নয় মাস ধরে কোনো অর্ডার নেই। কতদিন এভাবে চলবে কেউ জানেনা!  মুখ ধুবড়ে পড়েছে পরিকাঠামো। মনোবল হারিয়েছে ডলির মেয়েরা। 

বিয়ের পরেই স্বামীর  সংস্থা  সামলানোর দায়িত্ব এসে পড়ে ডলির উপর। একশোর বেশি মেয়েকে নিয়ে চলতে থাকে কাঁথা স্টিচের ব্যাগের কাজ। ভারতের সর্বত্র এই ব্যাগের চালান ছিল রমরমিয়ে। এখন প্রতিদিন মেয়েরা কাজ শুরু কবে জিজ্ঞাসায় কড়া নাড়ছে। ডলিও মানসিক ভাবে কিছুটা বিপর্যস্ত। উত্তর নেই কোনো কবে থেকে আসলে কাজ শুরু!

ঘরের প্রোডাক্ট বন্ধ অবস্থায় পড়ে। ডলিদির স্বামী একদা নিজের প্রোডাকশনের দেশব্যাপী মার্কেটিং করেছেন। তিনিও কিছুটা ক্লান্ত! অসহায় জিজ্ঞাসা কবে ঠিক হতে পারে অবস্থা! অর্ডার আবার কবে আসতে শুরু করবে!  ডলিদিও কার্যত হতাশ। ডলিদি জানায় ২০০০ সালে বন্যার সময় বস্তা বস্তা সিল্কের কাপড় ফেলতে হয়েছিল তবুও এমন পরিস্থিতি হয়নি।  লকডাউন একেবারে উদ্যোক্তাদের মেরুদন্ডে আঘাত। উঠে দাঁড়ানো দিনের পর দিন কঠিন হয়ে উঠছে।

রীতিমতো সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ীরাও মুখ আড়াল করছেন। সংকট এতটাই তীব্র। ডলিদির ব্যাগ অসাধারণ। খুব আকর্ষনীয়। মেয়েদের পরিশ্রম ও মনোযোগের স্পষ্ট ছাপ রয়েছে। ডলিদির কাছে প্রাথমিক কাজ শেষ করার পর তা স্বামীর কারখানায় পৌছায়। সেখানেও মহিলারা পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে। ডলিদি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলেন,"কটেজ ইন্ডাস্ট্রি  দেশের বড় ভবিষ্যৎ। মহিলা উদ্যোক্তা দের জন্য আলাদা করে ভাবনার দরকার আছে তো!"এটাও সত্য  ন্যাচারাল কালামিটি বা অন্যান্য দূর্যোগ  পরিস্থিতিতে  মহিলা উদ্যোক্তাদের জন্য আলাদা স্কিম থাকা দরকার। ফান্ড ড্রাই এর  মোকাবিলায় সরকার হাত না বাড়ালে মেয়েরা কোথায় দাঁড়াবে! সরকারি লোনের ক্ষেত্রেও তো সাড়ে বারো শতাংশ ইন্টারেস্ট প্রাথমিকভাবে গুনতে হয় মেয়েদের। ডলিদির কথার প্রতিফলন সরাসরি মেলে বাস্তব পরিস্থিতিতে। মহিলা-প্রতিষ্ঠিত স্টার্টআপস বা কোফাউন্ডার  মহিলাদের  স্টার্টআপসের পরিমাণ ভারতীয় স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমের মোট বিনিয়োগের ৬ শতাংশেরও কম।

"vocal for local" সাপোর্ট করতে গেলেও ক্রয়ক্ষমতা চাই! কোভিডের কারণে ক্রেতাদের পছন্দ এখন এসেন্সিয়াল ও নন এসেন্সিয়াল দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। গ্লোবালি ৯৩% ক্রেতা মনে করছে ব্রান্ডের নন এসেন্সিয়াল স্টোর বন্ধ করা দরকার। ইতালী, স্পেনে তা অলরেডি হয়েছে।  ডলিদিদের সমস্যা দিন দিন জটিল হচ্ছে। লাক্সারি গুডসের  চাহিদা না থাকলে উৎপাদন কি করে হবে? উৎপাদন না হলে জুড়ে থাকা মহিলা কর্মীদের ঘর কী করে চলবে?

kandi,berhampore

Friday 30 October 2020

অ্যাসিড আক্রান্ত মিলার লকডাউন যাপন

 ্মিলার লকডাউনের দিন

অসহায় বাবা  গাজন শেখ ফোনে কাঁদতে কাঁদতে জানালেন 'মিলা বাড়ি ছেড়ে চলে গেল।'  যে নিয়ে পালাল সেই  ছেলেই  মিলাকে গত বছর অ্যাসিড ছুড়েছিল। আপাতত মিলা সেই  ছেলের  বাড়িতেই। মিলার পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ তাদের উদ্ধার করে। পরে  মিলা  ছাড়াও  পায়। যদিও ছেলে জামিন পায় না। মিলা তখন দশম শ্রেণি। বিয়ের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় জানালা দিয়ে অ্যাসিড ছোঁড়া হয় মিলার মুখে। একবছর ধরে নিজে সেরে ওঠার যাবতীয় লড়াই এর পর পরিবারে মুখে হাসি ফোটে। লকডাউনের মধ্যেই মিলার নানা অসুস্থ হয়। তাকে দেখতে যাওয়ার দিনই ভোরবেলা মিলা গায়েব।


 ভাবতে অবাক লাগে এদেশে একদা সোনার আংটি বাঁকা হলেও দামি  ছিল শুধু তা নয়! অ্যাসিডে  আবার  বদমাস মেয়েরাই আক্রান্ত হয়। । কাকতালীয় ভাবে চলে যাওয়ার  দিনই মিলা আঠারো বছরের প্রাপ্তবয়স্ক  হয়।  বাবার চায়ের দোকান। লকডাউনে বন্ধ দীর্ঘদিন। ঘরে অভাব। দুই শিবির। মেয়ের পরিবার নিরক্ষর,একা। অন্যদিকে ছেলের পক্ষে সবাই। পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ছেলের অ্যাসিড মারার অপরাধকেও তুচ্ছ জ্ঞান করে! অপরাধী আর প্রেমিকের মধ্যে ফারাক কজনই বা করতে পারে? দেখার দৃষ্টিটাই তো গড়তে দেওয়া হয় না। এই ছেলেটি প্রথমে স্টকার ছিল। মিলাকে জোর করে বিয়ে করতে চেয়েছিল।পরিবার রাজি না হওয়ায় আক্রমণ। আমাদের দেশে এখনও  প্রতিদিন পেছনে আসা,দীর্ঘদিন ফলো করা ছেলেটিকে প্রেমিক বলেই ধরা হয়। এবং একদিন  এক স্টকারের সঙ্গেই প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে! রোমান্সের এইরকম সফট চার্মেই ভুক্তভোগীরও এই  বিশ্বাস গড়ে দেওয়া হয়  যে স্বামীর আসিড ছোঁড়া হাত সংসারে পড়লে আদরের হয়ে উঠবে।

মিলার উপর ঠিক কি ধরণের চাপ এসেছিল তা এখনই হয়ত জানা গেল না! কিন্তু মিলার সঙ্গে এমপ্যাথি থাক আমাদের। এমপাওয়ারমেন্টের এও এক বড় শর্ত। মিলার জীবনের সবচেয়ে বড় ঘাতকের   হাত থেকে মিলাকে বাঁচানো গেল না। সামাজিক অপমান,পারিবারিক অভিমান?  কী সেই ভাবনা মিলাকে ঘাতকের সাহচর্যে নিয়ে গেল এবং জুড়ে দিল তা  আড়ালেই থাকল। এরপরেও কনসেন্ট, ডিসিশন মেকিং এর ক্ষমতা যদি এই জীবন গড়ে দিতে পারে! অপেক্ষা সেদিনের!এভাবেই আসিডে পুড়ে যাওয়া মেয়েগুলো খবরের শিরোণাম থেকে হারিয়ে যায়! এদের লড়াই ধীরে ধীরে পারিবারিক লক্ষণরেখায় আটকে পড়ে। মিলা হাসিমুখে  ফিরবে একদিন  সেই বৃত্তে ইতি টেনে। আশা জাগে মনে।

ভরতপুর,মূর্শিদাবাদ

  


Sunday 11 October 2020

 বাউল শিল্পী আশালতার লকডাউনের দিন

দীর্ঘ ছয়মাস অপেক্ষা। তারপর লোকশিল্পীদের মুখে হাসি ফুটল। বাউল শিল্পী আশালতা অবশেষে বরাত পেল   প্রোগ্রামের। পর পর তিনটি। এতদিন মাসে মাসে শিল্পীভাতার হাজার টাকা জমা পড়ছিল। কিন্তু  মনে শান্তি ছিল না। ঘরে বন্ধ থাকতে থাকতে  অস্থির হচ্ছিল মন। অন্যদিকে  সামাজিক দূরত্বের কারণে দলের রেওয়াজও ছিল বন্ধ। আনলক-৫ ভাগ্যের  তালা খুলেছে আশালতার। পুজার আগেই তিনটি অনুষ্ঠানের তিন হাজার টাকা এসেছে। আশালতার  আনন্দের শেষ নেই।

লকডাউনের পর থেকেই মনমরা ছিল আশালতা। বাতিল হয়েছিল নিজেদের সাত জনের  দলের প্রোগ্রামও । অন্যদিকে সরকারি অনুষ্ঠানও ছিল বন্ধ। সব মিলিয়ে খুব কষ্টের যাপন ছিল আশালতার। স্বামী রাজমিস্ত্রীর কাজ করত। সেও বেকার বাড়িতে বসে। পারিবারিক অভাবকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল গান না গাইতে পারার কষ্ট। নিজের বলতে আশালতার এই বাউলগানটাই। আছে দুই ছেলে ও এক মেয়ে। সবাই স্কুলে পড়ে। কিন্তু  স্কুলও বন্ধ। পারিবারিক চাপও  ছিল আশালতার মাথার উপর। আপাতত সেসবে একটুখানি ছেদ পড়ল।



শেষমেশ আশা সব কাটিয়ে কাজে ফিরল। সূযোগও সামনে এসে গেল। পথশ্রীর জন্য,কৃষি বিলের প্রতিবাদে গান বাঁধল আশারা। সামনে দিকে চোখ সাজিয়ে এখন  আগামীর অপেক্ষা।

গনকর,মুর্শিদাবাদ

Sunday 27 September 2020

প্রতিমা শিলপী অনামিকা,দিপালী,ছবির লকডাউনের দিন

প্রতিমা শিলপী অনামিকা,দিপালী,ছবির লকডাউন যাপন 

পুজো চলে এসেছে। কিন্তু প্রতিমাশিল্পীদের সকলেরই আগের মত হাতে কাজ নেই। গতবারই ছিল আঠেরোটি পুজার বায়না। এবারে মাত্র ছয়টি। তাও আবার আগেরবছরের তুলনায় অর্ধেকের কম বায়না। অনামিকা পটুয়া, দিপালী ও ছবি পটুয়ায় মন তাই স্বভাবতই খারাপ। স্বামীরা ঘুরে ঘুরে এর বেশি বায়না জোগাড় করতে পারেনি। আবার প্রতি বছর কয়েকটি পটুয়া ও ঘোষ ঘর মিলে নিজেদের দুর্গাপুজা হয়। সেটাও বন্ধ। দুর্গাপুজার বায়না সেরকম না মেলায় নিজেদের পুজাটারও বাজেট জোগাড় করা যায় নি। প্রায় ১২ বছরের বেশিদিন ধরে চিত্রকরদের নিজেস্ব পাড়ার দুর্গাপুজা তাই বন্ধ। মনমরা বাতাবরণ মুর্শিদাবাদ গনকর চিত্রকর পাড়ায়।


প্রতিবছরের ব্যস্ত সময়ে এবারে যোগ হয়েছে অন্য শুন্যতা। অনামিকাদের আবার কাজে বাধ সেধেছে রাস্তা। খারাপ রাস্তা দিয়ে প্রতিমা নিয়ে যাওয়া কঠিন। সে ভেবেও হয়ত কেউ কেউ আসে নি ঠাকুরের অর্ডার নিতে। এমনটা দিপালীদেরও মনে হচ্ছে। প্রতিমা তৈরির ঘরানায় বাড়ির সকলে যুক্ত। দিপালী পটুয়ার মেয়ে পিয়ালী উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছে। মা -মেয়ে মিলে বারো দিনেই একটা ঠাকুর করে ফেলে। আট থেকে বারো হাজার টাকা ঠাকুরপিছু পায়। কাজ শেষে আড়াই থেকে চার হাজার টাকা নিজেদের থাকে। সারাবছরে দুর্গাপুজার সময় বড় উপার্জন সেটাও এবারে হল না। প্রতিমা তৈরি একমাত্র জীবিকা দীপালিদের। সেখানেও বড্ড মুশকিলের মুখোমুখি এবারে। তবুও কাজ চলছে সেই আগের উৎসাহ নিয়েই। মুখে হাসি অমলিন মহিলা পটুয়াশিল্পীদের।

গণকর,রঘুনাথগঞ্জ,মুর্শিদাবাদ

Thursday 17 September 2020

মিড ডে মিল রাঁধুনির লকডাউন যাপন

 মিড ডে মিল রাঁধুনিপুষ্পর লকডাউনের দিন

পুষ্পরানি এক নক্ষত্রের নাম হতে পারত। কিন্তু আসলে এক  মায়ের নাম। এক সৎ ও  নিষ্ঠাবান শ্রমজীবীর নাম।  স্কুলের মুখ দেখা হয়নি! পড়াশুনা শেখা হয়নি। তাতে কি!  ছেলে এম টেক করেছে। মেয়ে এম এ পাশ করে বিএড করেছে। দুজনেই চাকরির অপেক্ষায়। লকডাউনের দিনে ছেলের চাকরি নিয়ে উদ্বিগ্ন। রান্নার গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত। সেটাও বন্ধ। তবু মিড ডে মিলের দিনগুলিতে হাজিরার ব্যস্ততা আছে। বাড়ি বাড়ি রান্নার কাজ চলছে।

প্রথমে বিড়ি বাঁধা দিয়ে উপার্জন শুরু। তারপর পরিচারিকার কাজ।  দুটি বাড়িতে  রান্নার কাজ। মিড ডে মিলের রান্নার  কাজে যোগ দেওয়া।  সংসার চালাতে অর্থের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে ঘুরে পুষ্প জোগাড় করেছে কাজ।

উত্তরণের  গল্পগুলো কেমন যেন মেঘে ঢাকা তারার মত ভেসে ওঠার অপেক্ষায়। মুর্শিদাবাদের পুষ্পরানি হালদার  সত্যিই ওম্যানফোকের রানি। অনেক আদর আর ভালোবাসায় এই রানির আঁচল ফুলে ফুলে ভরে দেওয়ার কথা। মুখে আটকানো বাড়ির মোটা কাপড় ছেঁড়া। দুই প্রান্ত দুই দিকে  সুতো দিয়ে বেঁধে হয়েছে মাস্ক। হাতে প্রায় অকেজো এক  মোবাইল। একটা বাটন বার তিনেক ঘাটলে পরে সাড়া দেয়। তাতেই নাম্বার খুঁজে   ডায়াল করে পুষ্প। নিজের নাম্বার তো জানেই না। চোখে - মুখে একটা অসহায়তার ছাপ এসেও যেন মিলিয়ে যায়!  লড়াই এ টিঁকে থাকার এক নিরীহ দম্ভ  ফুটে ওঠে ছেলে -মেয়ের কথায়। স্বামী ঠোঙা  তৈরি করত। পাশে নেই ছয় বছরের বেশি। পুষ্পকে এই দূর্দিনও ভেঙে দিতে পারেনি। দুই সন্তানকে  সামনের দিকে এগিয়ে দিতে  নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে।

নিজের শ্রম আর খেটে খাওয়ার ক্ষমতাটুকুও জীবনের বড় সম্পদ। আর্থিক  ও সামাজিক প্রতিকূলতাকে পরাস্ত করে দিশা খুঁজে বের করতে  পুষ্প এক বড় উদাহরণ। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে পরের প্রজন্মকে শিক্ষাঙ্গন থেকেই  প্রতিষ্ঠিত করার সংকল্প নেওয়া বড় কঠিন কাজ। সমাজের  প্রথম সারির অনেক মানুষের সঙ্গে তাই  পুষ্পর নাম উচ্চারণ হওয়ার কথা! জীবিকার সন্ধানে হয়ে ওঠা এক  মেইড সারভ্যান্ট  ও কুকের ছেলে এম টেক করে, মেয়ে এম এ পাশ করে তখন সমাজকে আরেক বার  এই হ্যাভস নট দের দিকে ফিরে দেখতে হয়! এক মহিলার স্বপ্ন দেখার স্পর্ধাকে কুর্নিশ করতে হয়!

জঙ্গীপুর,মুর্শিদাবাদ

Friday 11 September 2020

রুপার লকডাউন যাপন

 রুপার লকডাউনের দিন

রূপা বর্ধন পালের কাজটা চলে গেল। লকডাউনের মধ্যেই বলে দিল -আর আসতে হবে না। একটি ডাক্তারের চেম্বারে নাম লেখার কাজ করতে রুপা। সারা ভারতেই অসংগঠিত শ্রমিকের কপালে যে দূর্ভোগ লেখা ছিল লকডাউনে  তা থেকে রেহাই পেল না রূপাও। অনেক অনুরোধের পরও থাকল না চাকরি। এক মাসের বাড়তি টাকা হাতে গুঁজে দিয়ে কাজ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হল। এই লকডাউনে যে নিপাট বেকার থেকে কাটাতে হবে তা জানানোর  পরও মালিকের মন গলানো গেল না।  রূপা বেকার হয়ে গেল। পাঁচ হাজার টাকার চাকরিই ছিল বাবা হারা পরিবারে  রূপারএকমাত্র মেয়ের সম্বল। রূপার জীবন যুদ্ধের গল্পের মত।


মাত্র ৩০ বছর বয়স। সদ্য স্বামী  মারা গেছে। ছিল  চায়ের দোকান । যৌথ সংসার। এখন সেখানে দেওরের  মালিকানা।  মাধ্যমিক পাশ। কম্পিউটার কোর্সে  ডিপ্লোমা আছে। রুপা মাত্র ৩ বছর বয়সে পোলিও আক্রান্ত হয় ।এখনো লাঠি হাতেই হাঁটে। নিজে প্রচণ্ড লড়াই করে পড়াশুনা করেছে। বেলেঘাটায় ৬ মাস করে ট্রিটমেন্ট চলেছে। তারপর ফিরে এসে চালিয়েছে পরীক্ষা ও পড়া। রুপা নিজে খুব ঘরোয়া। নিজের শারীরিক চ্যালেঞ্জ কে হার মানিয়ে  স্বামীকে নিয়ে গেল ব্যাঙ্গালোর। স্বামী ছাড়া কেউ নেই। তাই নিজে বন্ধন  থেকে লোন নিয়ে স্বামীর চিকিৎসায় পাড়ি দিয়েছিল। কিন্তু বাঁচল না স্বামী। স্বামীর চায়ের দোকানেও বসতে  রাজি ছিল সে কিন্তু শ্বশুরবাড়িতে আপত্তি থাকায় সেটাও হল না। 

অনেক জায়গায় কাজের সন্ধান করে ক্লান্ত হয়ে ফিরছে রূপা। কিন্তু লকডাউনে কাজ মেলা প্রায় অসম্ভব। এখন অপেক্ষা শুধু স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরার।

বহরমপুর ,মুর্শিদাবাদ  


Saturday 13 June 2020

ডোমেস্টিক ওয়ার্কার ললিতার লকডাউন যাপন

 ললিতার লকডাউনের দিন

লকডাউন মানুষকে হাতে হাত মিলিয়ে বাঁচতে শিখিয়েছিল। কিন্তু এই সহমর্মিতার গল্পের পাশে কিছু কান্না লুকিয়ে ছিল। ললিতার মেয়ে টিউশনির পয়সা দিতে পারেনি। তাই লকডাউনে সেই পরিবারে বাসন মেজে ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছিল ললিতা মন্ডলকে।


অভাবের সংসার বরাবর ললিতার ছিল না। স্বামীর অসুস্থতায় পরিবারে নেমে আসে দূর্ভোগ। কাজ খুঁজতে বেরিয়ে পড়ে ললিতা। বাধ সাধে লকডাউন। দুই মাস পর আবার কাজে নামে  ললিতা। অনেক কষ্টে মাসে মাত্র হাজার টাকা উপার্জন হয়। তাও নিশ্চিত নয় প্রতিমাসের জন্য। মাঝপথে কাজ ছাড়িয়ে দিলে টাকা মেলে না দিন হিসেবে।  শ্রমের মর্যাদা নিয়ে গলা ফাটানো এই  সমাজ কিন্তু এদের অধিকারটা বুঝিয়ে দিতে ও কড়ায় গন্ডায় মিটিতে দিতে অপরাগ। কোবিড বিপ্লবে মাস মাইনে না পেয়ে কেঁদে ফিরল রাস্তায় অগণিত মেইড সারভেন্ট। 

বিশ্বজুড়ে একই চিত্র। ইথিওপিয়া থেকে কাজে যাওয়া  ৩৭ জন মহিলা ডোমেস্টিক ওয়ার্কারকে লেবাননের রাজধানীতে রাস্তায় নামিয়ে দেওয়া হল কিছুদিন আগেই। তাদের দেওয়া হল না কাজের পয়সা। ফিরিয়ে  দেওয়া হল না  তাদের পাসপোর্ট।  এমন কি ছুরি দিয়ে ভয় দেখানো হল দেশে ফেরার আবদারে। রাস্তায় আশ্রয় নেওয়া  মহিলার কথা জানাজানি হতেই লেবাননের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয় যে, এই মেইড দের ঘরে রাখার দায়িত্ব নিয়োগকারীদের। লেবাননে  কাফালা নামের  এক সিস্টেমের  মধ্যে দিয়ে এদের নিয়োগ করার ফলে ডোমেস্টিক ওয়ার্কারদের ভিসা নিয়োগকারীর সঙ্গে যুক্ত থাকে। তাই ওদের ঘরে ফেরাটা মালিকের মর্জির উপর নির্ভর করে। ওদিকে নিজের দেশ ইথিওপিয়াও এদের ফিরিয়ে নিচ্ছে না। এয়ার টিকিট শুধু ডলারে নেওয়া হয় ইথিওপিয়ায়। লেবাননে আর্থিক  সংকটের কারনে ডলার আক্সেস করা সম্ভব হচ্ছে না। দুই দেশের নিয়ম ও ব্যবস্থার ফাঁসে আটকে আছে এতজন ডোমেস্টিক স্টাফের ভাগ্য। দেশে ও দেশের বাইরে কাজের মেয়েরা এভাবেই  গভীর সমস্যায় জর্জরিত হচ্ছে। কাজ করেও  অপমান ও অনিশ্চয়তার  জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে ললিতারা।

মুকুন্দবাগ,মুর্শিদাবাদ 

Thursday 4 June 2020

টুনটুনি ও বেলী মেহুলির কোভিডকাল যাপন

টুনটুনি ও বেলীর লকডাউন যাপন

টুনটুনি মেহুলি বছর তিরিশের মহিলা। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনা। তবু জীবন থেমে নেই। ঘর দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন যে, এটি মানুষের বাসস্থান। লকডাউনে কেমন অবস্থা জিজ্ঞাসা করতেই ঝড়ের বদলে বৃষ্টি নেমে এল। অভিযোগ নয়। হতাশাও নয়। হয়ত অভিমান। কেউ আগে বুঝি কেমন আছ? একথাটিও ভুলে জিজ্ঞাসা করেনি! রোগের চিকিৎসা হয়। বিজ্ঞান তাই জানান দেয়। কিন্তু যাদের হয়না তাদের কি হয়? একথা বই এর সিলেবাসে লেখা থাকে না। শুধু দেখে যেতে হয় । এবং ভুলে যেতে  বা এড়িয়ে যেতে হয়।চোখ ফিরিয়ে নেওয়ার শিক্ষা সিলেবাস না দিলেও সমাজ দেয়! তাই হয়ত টুনটুনিরা বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির জয়গান গাওয়ার সুযোগ পায় না। সামনে সুসভ্য শিক্ষিত মানুষ দেখলে ডুকরে কেঁদে ওঠে! আসলে এই  লজ্জা কার এটাই এখন মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন! লকডাউনে  একবেলা আলু সেদ্ধ ।পরদিন একবেলা ভাত জোটে। একবেলা খাবার পাওয়াটাই জীবনের পরম পাওয়া আপাতত। 

বেলী মেহুলির হাতে সমস্যা। আঠাশ বছরের বেলী কাজ করতে পারে না ডান হাতে। একেই মহিলা। তারপরেও হাতের সমস্যা। কাজের হাত ! সব বর্গের সব মানুষের ভিড়ে এইটি বড় সত্য যে, মহিলার হাতটি সচল না হলে তার জীবনে নিশ্চিত বিপর্যয়। গঞ্জনার জীবন বেলীর। সবার মত মাঠে খাটার সুযোগ তার নেই। বাড়িতে অভাবে তাই মুখ ফুটে কিছু বলার ক্ষমতাও নেই। দিনে শুটকি মাছ আর ভাত। রাতে শুধুই আলু সেদ্ধ জুটেছে।    



জীবন আগেই সীমাবদ্ধতায় ভরিয়ে দিয়েছে। এখন পরিবারে এক কোনায় পড়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই। লকডাউন সকলের জীবনে নতুন হলেও টুনটুনি ও বেলীর খুব চেনা এই পরিস্থিতি। ঘরে বসেই কাজ করা। বাইরে যাওয়ার দিনটাই আসেনি। তবু লকডাউনে পরিবারের চাপ এসে পড়েছে। বসে খাওয়ার খোঁটা এসে পড়েছে। তাই অপেক্ষা সব স্বাভাবিক হয়ে ওঠার। মাঠের কাজ শুরু হলে পয়সা তো কিছুটা আসবে হাতে! বেলী বলে, রান্নাঘরে তো এখন শুধুই জলটুকুই পড়ে থাকে! এটাই ক্ষিদে মেটানোর বড় সহায়!   

শারীরিক অসুস্থতার সঙ্গে লড়াই করে  টুনটুনি ও বেলী ক্লান্ত। শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই। তাই উজ্জ্বল কোনও দিনের স্বপ্ন দেখাও নেই। তবু আক্ষেপ লকডাউন না থাকলে সংসারের হাল কিছুটা তো ভালো থাকত! 

নবগ্রাম,মুর্শিদাবাদ 

Tuesday 2 June 2020

মালতী মুর্মুর কোভিডকাল যাপন

মালতীর লকডাউনের দিন

বছর চল্লিশের মালতী। স্বামী সুই মুর্মু মাঠে খাটে। লকডাউনে মাঠের কাজ বন্ধ। ঘরে বসেই দিন কাটছে।মালতীও মাঠে কাজ করে। কিন্তু পয়সা রাখতে পারেনা। স্বামী পয়সা নিয়ে চলে যায় কখন টের পায় না। চাষের মাঠ থেকে দুজনে মিলে যেটুকু ধান পায় তা কেনা-বেচা করেই চলে বছর। এবারে হঠাৎ লকডাউন গুলিয়ে দিয়েছে মালতীদের জীবন। প্রতিদিনের খাওয়া কোনোদিনই নিশ্চিত ছিল না। তবু চলে যেত ভাত-রুটি বদল করে দিন। এবারে সমস্যা ঘরে বসা স্বামীকে নিয়ে। কাজ না থাকলেও নানারকম চাহিদা ও নেশা আছে। তাতে পয়সা লাগে। সেটা না পেলেই বাড়িতে অশান্তি বাড়ছে। এতদিন মাঠে কাজ করে এসেই বাড়ির পুরষ শান্ত থাকত। কাজ না থাকলেও অন্য ব্যস্ততা থাকত। লকডাউনে বেড়েছে অত্যাচার। কাজ নেই কিন্তু অনান্য চাহিদা বেড়েছে।

মালতীদের জীবনে শিক্ষার কোনও জায়গা নেই। বড় হয়েছে অভাবের পরিবারে। বিদ্যালয়ের মুখ দেখা হয়নি। বিয়েটাই বেঁচে থাকার একমাত্র লক্ষ্য বলে জানা ছিল। এটাই ছিল পারিবারিক দায়। তাই বিয়ে একদিন হয়েই গিয়েছিল। কিন্তু জীবনে ভালো কিছু পাওয়ার গ্যারান্টি ছিল না। জন্মস্থলে ও সংসারে অবস্থার কোনও বদল হয়নি। দারিদ্র ছিল জীবনের সবচেয়ে বড় কাছের বন্ধু। মালতী নিজেও জানে সে অপুষ্টির শিকার। ডাক্তার ওষুধ লিখে দিলেও কেনার ক্ষমতা নেই। তাই এভাবেই চলছে দিন। এর মধ্যেই এসে পড়েছে লকডাউনের অভিশাপ।


 

মালতীর লকডাউনের সময় রাতে শুধু শুটকি মাছ আর লবন। দিনে ভাত সেদ্ধ। ঘরে চা পাতা আছে পড়ে সামান্য। চিনি নেই। বিস্কুটও নেই। এদিকে  ইনকাম ও বন্ধ। পাশের বাড়ির সঙ্গে ধান-চাল বিনিময় করে আর কতদিন! ফুরিয়ে আসছে ঘরের জিনিষ একে একে। মালতীদের দিন বড় আবার রাতও  পাল্লা দিয়ে বড় হচ্ছে! এখন সকালের অপেক্ষা। কিন্তু ভোরের আলোতেও সেই এক অন্ধকার! ভাগ্যে লকডাউন জীবনভর। 


নবগ্রাম,মুর্শিদাবাদ 

           


Monday 1 June 2020

জুলিয়ানা হাঁসদার কোভিডকাল যাপন

 জুলিয়ানার লকডাউনের দিন

সভ্যতা মানুষকে শিক্ষিত করে। জীবনের জন্য প্রয়োজনের সব উন্নত কিছুর হদিস দেয়। পদে পদে অমসৃনতার  সামনে পড়া সীমাবদ্ধতাকে জয় করতে শেখায়। কিন্তু সেই সুসজ্জিত সভ্যতার এক কোনায় যখন অন্ধকারের যাপন নজরে আসে তখন থমকে যেতে হয়। পিছুটান হাতছানি দেয়। এই অসহায় মুখগুলিকে আলোর সামনে এসে মুখোমুখি দাঁড় না করতে পারার জন্য অনুশোচনা হয়। এই যন্ত্রণা নিয়ে  আর যাই হোক নিজেকে সুসভ্যতার অংশীদার বলে দাবী করা যায়না। চিকিৎসা ও প্রযুক্তির শিখরে থাকা দেশের কোনও প্রান্তের মানুষ যখন সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয় এবং অসুখের সঙ্গেই বাস করাকেই ভবিতব্য মনে করে তখন বিজ্ঞানও লজ্জায় মুখ লুকায়। জুলিয়ানা হাঁসদার লকডাউনের দিন সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে ক্লান্ত হয়। বেঁচে থাকার অধিকার তো মানুষের মৌলিক অধিকার। খাওয়া ও চিকিৎসার অধিকার তো এর মধ্যেই পড়ে! কিন্তু একাংশ তা থেকে বঞ্চিত কেন হবে! জুলিয়ানাসহ দুই বাচ্চাকে দেখে মনে হল এ যেন আফ্রিকার কোনও অঞ্চলের বুভুক্ষ মানুষের ছবি। যেমন গুগুলে সার্চ করে পাওয়া যায়! অপুষ্টি,বিকলাঙ্গ অসহায় এই বাচ্চা দুটিও এই দেশের ভবিষ্যৎ। তবু নিউ ইন্ডিয়ার সাইনিং এদের মুখে পড়তে ভয় পায়!   

জুলিয়ানার দুই ছেলে। একটির ছয় ও অন্যটির দুই। দুটি বাচ্চাই ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জ। ডাক্তার বলেছে দুইজনের সার্জারি করতে হবে। পয়সা নেই। কোনও উপায় না দেখে জুলিয়ানা ছেলেকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে পালিয়ে আসে। তারপর ছেলে ভর্তি হয় ক্লাস ওয়ান এ। সেখানে সে বুলিং এর শিকার । এই পোড়া দেশে অসুখের নামেও ফান হয়। সহানুভূতির বদলে ল্যাংড়া বলে ডাকা হয়। ছেলে কদিন বিদ্যালয়ে যেতে পারবে জানেনা জুলিয়ানা! শুধু জুলিয়ানার বিশ্বাস ভগবান তাদের সঙ্গে খারাপ কিছু করবে না। ছেলেদের ভগবান বাঁচিয়ে রাখবে। এভাবেই জরুরি চিকিৎসা ছাড়া বেঁচে আছে বাচ্চা দুটো। ভারতবর্ষের ভগবান কতদিন এদের বাঁচাবে কে জানে! 

স্বামী মাইগ্রান্ট লেবার। লকডাউনে ফিরেছে খালি হাতে। তাই অন্য অভিশাপ জুলিয়ানার জীবনে নেমে এসেছে। হাঁড়িতে চাল আছে। রেশনে পাওয়া। আর লবন আছে। সব্জি বলতে এটাই। শুনেছে আলু পাবে। হাতে আসেনি। পেলে সেটা বাজারে বিক্রী করে মশলা কিনবে। ভরসার শাক মাঠে পড়ে। ইচ্ছে করে না জুলিয়ানার তুলে আনতে! শুধু ভাতও কদিন পাবে জানেনা। স্বামীর কাজ নেই। জুলিয়ানা নিজে পড়াশুনা করেনি। অভাবের সংসারে বিয়েটাই বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল ছিল।সেটাই করে দিয়েছিল বাপ-মায়ে। ছেলেদের শিক্ষিত করার বড় স্বাদ! কিন্তু বাঁচাতে পারলে তো! কোবিড নিয়ে জুলিয়ানা কিছু জানেনা। কোভিডে মানুষ মরে! কিন্তু ওরা বেঁচেই বা কবে ছিল। অভাবেই জন্ম অভাবেই শেষ। মাঝে শুধু একটা বিয়ে ও দুইটি বাচ্চা। এইরকম একাধিক জুলিয়ানা ভুগছে প্রতিদিনের অসুখে। পরের প্রজন্মকেও দিয়ে যাচ্ছে দারিদ্রের উত্তরাধিকার! যুগ যুগ ধরে জুলিয়ানাদের ললাট লিখন কি বদলাবে? এদের কপালে লকডাউন লেখা আজীবন। খোলার সাধ্য  জুলিয়ানার বিশ্বাসের  কোন দেবতার! কে জানে!        

 নবগ্রাম,মুর্শিদাবাদ

   



Sunday 31 May 2020

অভিবাসী শ্রমিক রিম্পার তালাবন্দি জীবন

রিম্পার লকডাউন যাপন

অভিবাসী শ্রমিক রিম্পা লুধিয়ানা থেকে গ্রামে ফিরে বাচ্চাদের কাছে পৌঁছাতে পারল না। ১৪ দিনের  হোম কোয়ারান্টাইন। ইদেও বাচ্চাদের একটিবার ছুঁয়েও দেখা হল না। বছরের শুরুতে  গিয়েছিল কাজে পাঞ্জাবে। কারখানায় প্যাকেটিং এর কাজ করত। সংসারের অভাব দূর করতে নিজের দুই বাচ্চাকে মায়ের হাতে তুলে দিয়ে পাড়ি দিয়েছিল পাঞ্জাব। মাত্র নয় ও দশ বছরের বাচ্চা দুটোকে গ্রামেই ফেলে যেতে
হয়েছিল পয়সার খোঁজে।


নবম শ্রেনি পাশ রিম্পার বিয়ে হয়ে যায় কম বয়সে। রিম্পার আব্বা দিনমজুর। মেয়ের পড়াশুনা টানার চেয়ে সংসারে থালা কমানো জরুরি ছিল। রিম্পাকে তাই নিজের বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে হয় বিয়ে করে। কিন্তু অভাব পিছু ছাড়ে না। স্বামীর ঘর করতে গিয়েও সেই অভাবের সঙ্গে লড়াই জারি থাকে। ছেলেরা একটু বড় হতেই রিম্পা বুঝে যায় এভাবে চলবে না। কিছু একটা উপায় বের করতেই হবে। গ্রামে পয়সা উপার্জনের কোনোও রাস্তা সে খুঁজে পায়না। অবশেষে বিদেশে শ্রমিকের কাজে যোগদানের কথা ভাবে। গ্রামের অনান্য অভিবাসী শ্রমিকদের সঙ্গে দল বাঁধে।

লুধিয়ানায়  দুই হাজার টাকা দিয়ে  ঘর ভাড়া নেয়৷ লকডাউনের সময় ফিরতে চাইলে পুরো বাড়ি ভাড়া মিটিয়ে দিতে বলে মালিক। রিম্পাদের কাছে টাকা না থাকায় তাদের ঘরটাও রেখে আসতে হয়েছে। এখন এদের অবস্থা জলে কুমির ডাঙায় বাঘ এর মত। গ্রামে কাজ নেই। যেখানে কাজ সেখানে ফেরার কি উপায় জানা নেই। ফেরার পর কাজটা ফিরে পাবে কিনা জানেনা।

মাত্র ২০০ টাকার মজুরীতে কাজ করে রিম্পা। ২০২০ সালের এপ্রিল মাস থেকে অদক্ষ শ্রমিকের ন্যূনতম  মজুরীর  স্ল্যাব অনুযায়ী শিল্প শ্রমিক পাবে ৫২৩টাকা - ৪৩৭টাকা -৩৫০  টাকা।  কিন্তু বাধ্যতামূলক  ন্যাশন্যাল ওয়েজ ফ্লোরের পথ না ধরায় আঞ্চলিক বৈষম্য থেকে গেছে। রিম্পারা তারই শিকার। অন্যদিকে মজুরীরতে লিঙ্গ বৈষম্যের দিক তো প্রবল ভাবে আছে। যে কাজে রিম্পা দুশো টাকা সেই কাজেই একজন পুরুষ পাচ্ছে  তিনশো থেকে সাড়ে তিনশো টাকা। রিম্পার স্বামীও দিনমজুর। তার কাজের দিনে  আয় হয় পাঁচশো। আসলে ন্যূনতম মজুরী নির্ধারণের জন্য আই এল ও থেকে  পাওয়া গাইডলাইন মানা হয় না। কর্মাচারী ও উদ্যোগপতিদের মধ্যে বৈধ প্রয়োজনের ভিত্তিতেই সমতা আনা সম্ভব। সেই নিরিখে কালেক্টিভ বারগেইনিং বা সামাজিক কথোপকথন হয় না বললেই চলে। উদ্যোগপতিদের সুবিধা বেশি করে দেখা হয়।

2018 এর আই এল ও এর  প্রতিবেদনে ভারত এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ২২ টি দেশের মধ্যে বেতন সন্তুষ্টিতে তলার দিক  থেকে চতুর্থ স্থানে রয়েছে ভারত। বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং মঙ্গোলিয়ার উপরে।

লকডাউনের সময় মজুরি পাওয়ার ক্ষেত্রে রিম্পাদের বাড়তি সুবিধা নেই। আগাম টাকা দিয়ে দেওয়ার প্রস্তাবও নেই। এই পরিস্থিতিতে নিজেদের ও পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যে কাজের দরকার সেটাও হাতে নেই। অভাবে দুচোখ অন্ধকার দেখা ছাড়া আর হাহাকার করা ছাড়া রিম্পাদের কিচ্ছু করার নেই।

গোবড়গাড়া,হরিহরপাড়া,মুর্শিদাবাদ

Saturday 30 May 2020

কারখানা শ্রমিক নূরের তালাবন্দির দিন

নূর খাতুনের লকডাউন যাপন

"কাজ ঢুড়ে পাইনিখো! তাই ঘর ছেড়ে ম্যাশিনের কাজে বিদ্যাশ যাওয়া।" কারখানার কাজে নিযুক্ত নূর খাতুন একদম পেটের দায়ে পাঞ্জাব পাড়ি দিয়েছিলেন। প্রায় নয় বছর ধরে কাজ করছেন। লকডাউনে নানা ঝামেলা অতিক্রম করে ঘরে ফিরেছেন। সমস্যা হল নূর নিজের বয়সটাও সঠিক জানেন না। আবার সাবলীল ভাবে বলে, "কিছুই বুঝতুক না তখন বিহা। বাপ কে কাজ করতে য্যাতে দেখিনি। ভাইরা মাঠে ঘাটে খাটতক। ওয়্যাই লেগে স্কুলে যায়নি। পড়ায়নিখো।"

উনি আসলে একজন শ্রমিক সেটাও বোঝেন না সেভাবে। তাই শ্রমিকের অধিকার নিয়ে তার কিছুই জানা নেই। সকাল আটটায় দু হাজার টাকার ভাড়া ঘর থেকে ফ্যাক্টরি যেতেন । ফিরে আসেন রাত আটটায়। এত ঘন্টা ধরে মেশিনে মাল তুলতে সহায়তা করে তারপর প্যাকেটিং এর কাজ করতেন। রবিবারেও কাজ চলে। "শুধু কাজে ঢিল পড়লে ছুটি"। নূর বলে, "দুইডা টেশিন। একডা সামনে। একডা পিছনে। একডাতে নাট বল্টু চড়াতু। তারপর আর এক জাগায় এর এক টেশিনে ট্রেসিং করতু। তাপর গনতি করতু। তারপর প্যাকেট বানাতু।" একদিনে তিন জায়গায় কাজের নামে তাকে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়ানো হয় নূরকে। মাত্র দুশো টাকার বিনিময়ে। এভাবেই নাট বল্টু তৈরির সহায়ক হিসেবে কাজ করেন লুধিয়ানায় এক যন্ত্রাংশ নির্মাণের কোম্পানীতে । নূর এটাকেই কাজ করা বলে জানে। সেই কাজ সে সংসারের জন্য করছে। কারণ সে গরিব। তিন ছেলে মেয়ে নিয়ে স্বামীর একার উপার্জন যথেষ্ট নয়। তাই তার কাজ করাকে সে নিয়তি বলেই মেনে এসেছে। স্বামীও পাঞ্জাবে তামা -লোহা কাটার কাজ করে।


নূর বাড়ি ফিরে এসে পড়েছে বিপদে। লকডাউনেরর জন্য টাকা পায়নি। স্বামীর কাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। জমানো টাকা খেয়ে দীর্ঘ দেড় মাস লড়াই এর পর ফিরে এসেছে ইদের আগে গ্রামে। ছেলে মেয়েদের নতুন জামা দূরে থাক খাবারও কিছু কিনতে পারেনি। নিজে একটা নতুন শাড়িও পরতে পারেনি ইদের নামাজের দিন।

লকডাউনে তড়িঘড়ি পালিয়ে এসেছে দেশে। এখনোও পাঞ্জাবে ঘরে সব তালাবন্দি। কখন ফিরতে পারবে জানেনা। ফিরে কাজ থাকবে কিনা তাও জানেনা। এদিকে ঘর ভাড়ার টাকা তো গুনতে হবে ভেবেই মাথায় হাত নূরের। মহিলা শ্রমিকের আলাদা স্বীকৃতি নেই। সামান্য টাকায় নানারকম কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকতে হয় তাকে। পারিশ্রমিক সামান্য। প্রতিদিন শ্রম চুরি। কিন্তু নূর কাজ করে খায় এতে খুব খুশি। "ব্যাটাছেলের সঙ্গে কথা কহিতে দেয় না। ম্যায়াদের সঙ্গে ম্যায়ারা একসঙ্গে কাজ করত। নিজের নিজের পায়সা নিয়ে বাড়ি আসতু। কাজে ভালো লাগত।"

এই হাড় ভাঙা বেহিসেবী কাজে নূরদের কোনোও অভিযোগ নেই। শেষ কথা "সাহাব খুব ভালো। ব্যাটাছেলেদের আলাদা আর মেয়্যাছেলেদের আলাদা ঘর কাজের।" এদের কাছে ভালো হতে গেলে বিশেষ কোনোও গুনের দরকার হয়না। এতটা সরল মহিলাদের শ্রমিক হিসেবে বছরের পর বছর অতিরিক্ত খাটিয়ে কোম্পানী মুনাফা করতে থাকে। কিন্তু বিপদে একমাসের মাইনে আগাম দিয়ে বাড়ি পাঠানোর দায় মাথায় নেয় না।
রুকুনপুর,হরিহরপাড়া, মুর্শিদাবাদ

রেনুকা খানমের লকডাউনের দিন

 রেনুকার লকডাউনের দিন

 গ্রুপের নাম ভরসা হলেও রেনুকা ৪৫ টি পরিবারের ভরসা হয়ে উঠতে পারল না। দীর্ঘ লকডাউন কোমর ভেঙ্গে  দিল রেনুকার। ঘরভর্তি জুটের ম্যাট,তারের ব্যাগ  ও দেওয়াল সজ্জার  জিনিষ নিয়ে হস্তশিল্পী রেনুকা  একেবারে অসহায়। মেলা বাতিল। বিক্রী বন্ধ। প্রতি বছর দমদম,বারাসত থেকে অর্ডার আসে ম্যাটের। তারপর বাসে করে প্রোডাক্ট দিয়ে পাঠায় রেনুকা। এবারে সেটাও হয়নি। রেনুকার নিজের দলের বারোজন মেয়ের বাইরে আছে প্রায় তেত্রিশ জন। সকলেই হাত গুটিয়ে বসে আছে।  এদের অনেকের পরিবারে নিজেদের উপার্জন ছাড়া অন্য কোনও আর্থিক সংস্থান নেই। রেনুকার পরিবারে স্বামীর উপার্জন  লকডাউনের পর চালু হওয়ায় কোনওভাবে সংসার চলছে। কিন্তু নিজের সঙ্গে জুড়ে থাকা মেয়েদের সাহস জোগাতে পারছেনা রেনুকা।লকডাউনের অর্তকিতে হানা। বানানো জিনিষের চাহিদা নেই। এদিকে মেয়েদের কাজ বন্ধ থাকায় হতাশা ও কষ্ট বেড়েই চলেছে।



 মূল সমস্যা হচ্ছে রেনুকাদের মেইনস্ট্রিম মার্কেটের সঙ্গে যোগাযোগ খুব বেশি গড়ে উঠছে না। লার্জ স্কেল এন্টারপ্রাইজ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রেও বেশি দূর এগিয়ে নেই ওরা।যদিও ভারতে পঞ্চাশ মিলিয়ন মহিলারা সেল্ফ হেল্প মুভমেন্টের অংশীদার।রেনুকারা আর্টিজান কিন্তু ফ্যাশন ডিজাইনার ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে এরা গাঁটছড়া বাঁধতে পারেনি।

মেলার অপেক্ষায় দিন কাটে। তার মূল কারণ এরা কেউ টেকনোলজি ফ্রেন্ডলি নয়। ইনফরমেশন ও নেই এদের কাছে। নিজের কাজ বিশ্বের দরবারে বাইরের উদ্যোগ ও সাহায্য ছাড়া কিছুতেই নিয়ে যাওয়ার সাধ্য নেই। বিপদের সময় মানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বিপর্যয়ে  এরা পুরোপুরি বিধ্বস্ত। নিজের দলকে বা মেয়েদের বাঁচানোর সাধ্য প্রায় নেই বললেই চলে! গ্রুপ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছে। তবুও আশায় দিন গুনছে রেনুকা।



Friday 29 May 2020

গোলাপির তালাবন্দির দিন


গোলাপির লকডাউন যাপন

বাচ্চা বায়না ধরেছে দোকান যাবে।  গ্রামের ভেতরের দোকান খোলা। কিন্তু গোলাপির সাহস নেই। তিন ছেলে -মেয়ের হাত ধরে নিয়ে দোকানের দিকে  যাওয়ার। কি কি  খেতে চাইবে বাচ্চারা কেজানে! এদিকে হাতে মাত্র কুড়ি টাকা আছে গোলাপির।  তাও মা  এসে বাচ্চাদের কিছু কিনে খাওয়ার জন্য দিয়ে গিয়েছিল। গোলাপি  টাকা কোথায় পাবে? স্বামী তো বাড়িতে বসে পাক্কা দুই মাস। সংসার তো বাপের বাড়ির লোকই টেনে দিচ্ছে। কিন্তু কতদিন!


গোলাপি স্কুলে যায়নি। সময়ের আগেই বিয়ে।  তিনটে বাচ্চা নিয়ে পাখির বাসার মত দেখতে ঘরে বাস। ডাল -পাতা-কঞ্চি দিয়ে তৈরি গোলাপির ঘর। আবাস যোজনা ও সরকারি প্রকল্প  মাথা হেঁট করবে। আশ্চর্য হয়ে মানুষ প্রশ্ন করবে গোলাপী  এখনো বাড়ি পায়নি কেন? যদিও এটাই গোলাপীর তাজমহল। বিয়ে হয়ে গেছে মানেই শাহজাহান পেয়ে গেছে।  জীবনের বড় পরীক্ষায় পাশ করে গেছে। লকডাউন না এলে  গোলাপি জানতই না যে তিন ছেলে -মেয়ের জন্য প্রতিদিন ভাত জোগাড় করা এত বড় চ্যালেঞ্জ। স্বামীর রোজগার শূন্য। হাতে নগদ পয়সা নেই।

"খ্যাতে দিলে ভালো হয়। ঘর যদি দেয় তো খুবই ভালো হয়" নিষ্পাপ মন নিয়ে বলে গোলাপি। স্বামী পাইপের কাজ করে। কখনো অদক্ষ শ্রমিকের কাজ করে। কাজে গেলে টাকা আনে।  নইলে বাড়িতে বসে। যে টাকা আনে  তা ফুরালে আবার কাজে যায়। লকডাউনে চাল আটা যা পেয়েছে তাতেই চলছে। লকড়ির অভাব। তাই দুইবেলা ভাতের চাল ফুটানো  কঠিন। পেঁপে,শাক, ডাঁটা জোগাড় করে দিন চললেও নগদ পয়সা হাতে না থাকায় চায়ে চিনি দেওয়া মুশকিল।

বাচ্চা আবার স্কুলে যায়। দ্বিতীয় শ্রেণি। কতদিন যাবে গোলাপি জানেনা। বাপের হাত ধরে কাজেও নামতে হতে পারে! গোলাপি বলে, "আমি তো স্কুলে যাইনি তাতে কি হয়েছে? আমি কি করতে পারি না?" একদম তাই। গোলাপীদের ছেলেমেয়েদের কাছে পড়াশুনা এক রকম বিলাসিতা। এটা না শিখেও মানুষ বাঁচে এ তাদের  স্থির বিশ্বাস। পড়াশুনা নামক  বিলাসিতা দূর করার জন্য গোলাপির ছেলেদের হাত ধরার কেউ নেই। দিন বদলেছে। মানুষ অসাধ্য সাধন করেছে । কিন্তু প্রদীপের তলায় অন্ধকারের মত আড়াল থেকে গেছে গোলাপিদের জীবনে সুদিন ফেরার গল্প। লকডাউন তো গোলাপিদের জীবনটাকেই আলেয়ার মত ছুটিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে।  এত বড় বিপদের সামনে বুক চিতিয়ে  দাঁড়িয়ে তাদেরও পাল্টা চ্যালেঞ্জ "রোগে মরতাম ব্যাপার না৷ কিন্তু এমনি করে ভিক্ষা করাবে ক্ষ্যামতা থাকতে? আমাদের তো জাত গেল।"
শেখপাড়া, কুলগাছি,ভগবানগোলা ১

Thursday 28 May 2020

বিড়ি শ্রমিক সোনামনির তালানবন্দির দিন

সোনামনির লকডাউন যাপন

"লকডাউনে ঘরে তো আমরা বেকার। সরকার থেকে চাল দিয়েছে। নগদ পাঁচশো টাকাও দিয়েছে ব্যাংকের খাতায়। কিন্তু সে টাকায় তো একদিন মাংসও খাওয়া হবে না। সারা মাস তরকারি,মাছ খাওয়া হবে কি করে? ঘরে রাখা বাড়তি চাল যদি আজ বেঁচে দিই তো কদিন ডাল -তরকারি হবে?" প্রশ্ন বিড়ি শ্রমিক সোনামনি সাহার। প্রায় দশ বছরের বেশি বিড়ি বাঁধছে সোনামনি। নেই কোনও কার্ড। নেই শ্রমিকের স্বীকৃতি।

পড়াশোনা নাকি গরীব মেয়েদের জন্য নয়। তাড়াতাড়ি মেয়ের বিয়ে দিয়ে মাথার বোঝা না নামলে মুশকিল। এটাই বিশ্বাস সোনামনির। সে বেজায় খুশি যে লকডাউনের আগেই তার পরিবারের সদস্য সংখ্যা দুই জন কমেছে। দুই মেয়ের বিয়ে না হয়ে গেলে বড় ও ভারি সংসারের চাকা বন্ধ হয়ে যেত লকডাউনে! দেড় মাসের বেশি সোনামনি বিড়ি বাঁধেনি লকডাউনের জন্য। এখন বিড়ি বাঁধার সূযোগ  এলেও শরীর ঠিক চলছে না। তাই বিড়ির পাতা নেয়নি। সোনামনি সাহার বিয়ে পনেরো বছর বয়সে। তারপর  সংসারের ভার মাথায় এসে পড়ে। পরিবার  বেকার স্বামীর হাতে সোনামনিকে তুলে দিয়ে দায় সারে। নিজের বিড়ি বাঁধার বাইরে বাপের বাড়ি থেকেও সাহায্য আসতে থাকে। কিন্তু এভাবে হাত পেতে কতদিন? তাই  অবশেষে স্বামী কে সাকার করার দায় সোনামনি মাথায় তুলে নেয়। নিজের বিড়ি বাঁধা থেকে জমানো টাকা ও বাবার সাহায্য নিয়ে স্বামীকে কিনে দেয় ভ্যান। দুই মেয়ে ও এক ছেলে মানুষ করে এভাবেই।


নিজে টাকা উপার্জন করলেও সোনামনির লকডাউনে বড় চ্যালেঞ্জ স্বামীর ঘরে বসে যাওয়া। বছর পাঁচেক আগে সোনামনির বাবা বেকার জামাইকে ভ্যান কিনতে সাহায্য করে। তারপর সেটা থেকে ভালো আয় না হওয়ায় আবার কিছুদিন আগে টুকটুক কিনতে সাহায্য করে। তারপরেই লকডাউনে ঘরে বসে যায় স্বামী। এতদিন সংসারের জন্য হাজার, দেড় হাজার  বিড়ি বেঁধে এসেছে সোনামনি। এখন শরীর সঙ্গ ছেড়েছে। তিনশো বিড়ি বাঁধতেই হাঁপিয়ে উঠছে। তবু লকডাউনে  উপার্জন মার যাওয়ায় মন খারাপ সোনামনির।

 নিজের বাবার দৌলতে একটা গ্যাসের সিলিন্ডার ঘরে আনতে পেরেছে সোনামনি কিন্তু রান্না সেই বাড়ির আখাতেই হয়। লকড়ি জোগাড় করে করতে হয়। বাড়িতে স্বামী ও ছেলের ভার তার মাথার উপরেই। সংসার এভাবেই চলেছে। লকডাউনেও নিজের বাপের বাড়ির সাহায্য নিয়ে চলেছে সোনামনি। ঘরে চাল আছে। কিন্তু তার বাইরের ব্যবস্থা করার জন্য কেউ এগিয়ে আসে নি। তবে ঝড়ের গতি তেমন আকার না নেওয়ায় মাথার উপরে  টালি বেঁচে আছে। আশ্রয়হীনতা থেকে রেহাই পেয়েছে সোনামনি।

সোনামনি নিজের অন্দরমহলের কাঁটাছেড়া বেশি না করে একটিই কথা বলে,"গরীবের  কী দাম আছে! অভাবের সংসারে লকডাউন, বৃষ্টি- ঝড়ের দাপট চললে মরে যাওয়ার কথা কিন্তু তা তো হয় না। প্রতিবার টাল ভাঙা পড়ে, প্রতিবার আবার মাথার ছাদের মেরামতি চলে! প্রতিবার বৃষ্টিতে ত্রিপল ছেঁড়ে, প্র‍তিবার কিনতে হয়।" সোনামনি বলে, "দুই মাস একটা মানুষ  টুকটুক না চালিয়ে ঘরে বসে থাকলে সে ঘর কেমন থাকবে! বেঁচে আছি। কিন্তু মানুষের অধিকার  কেউ দ্যায় না।" লকডাউনে চাল,আটা পেলাম। কিন্তু দুই মাস আট দিন কি তাতে চলে!
সাহাপাড়া,লালখানদিয়ার ,মুর্শিদাবাদ

পূর্ণিমার লকডাউনের দিন

পূর্ণিমার লকডাউনের দিন

ছোলা কিনে ছাতু তৈরির ব্যবসা পূর্নিমার। বিয়ের পর থেকেই এই ব্যবসা শুরু। স্বামী চোখে ভালো দেখে না। তাই ঘরে বসেই চলে এই ব্যবসা। লকডাউন বাধ সেধেছে রোজগারে। বাজারে ছোলা কেনা যায়নি। তাই তা এনে ভেজে ও পিষে প্যাকেট করে বিক্রীর কাজও বন্ধ।  মাসে ৩০-৩৫ কেজি ছাতু বিক্রী হয় পুর্ণিমার। ৫০/১০০/২০০/৫০০ সবরকম দামের প্যাকেট তৈরি করে। লকডাউনে কাজ আটকে পড়ে আছে। বছর পঁয়ত্রিশের পূর্ণিমা একেবারে নাজেহাল। 

ছাতু বিক্রী করে  লাভ থাকে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। ছেলের ছয় বছর। নিজের অভাবের পরিবার ।তাই পূর্ণিমার লেখাপড়া শেখা হয়নি। সময়ের আগেই বিয়ে। সেখানেও খুব বেশী স্বচ্ছলতা নেই। স্বামীর নিজেস্ব ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। শারীরিক অসুস্থতার জন্য। পুর্ণিমাকে সংসারের দায় কাঁধে তুলে নিতে হয়। পরিবারে সময় দিয়ে উপার্জনের কথা ভেবেই ছাতু বিক্রীর কথা মাথায় আসে। সাহস করে ব্যবসা শুরু করে পূর্ণিমা। তারপর এই লকডাউনের যন্ত্রণা। টানা দুই মাস পর কাজ শুরু হলেও বিক্রী কমে যায়। ঘরের বাইরে লোক কম বেরোতে থাকে। প্যাকেটস্থ ছাতু বাড়িতেই পড়ে আছে উদ্বৃত্ত।


 

পূর্ণিমা অপেক্ষা করছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার। সংসার চালানো খুবই কঠিন। জমানো কিছু টাকা খরচ হয়ে যাওয়ায় আশংকা আগামীতে কী হবে? ছেলে নিয়ে একদম কঠিন লড়াই এর  দিন কাটছে পূর্ণিমার।

গোকর্ণ,মুর্শিদাবাদ   


Wednesday 27 May 2020

বাসন্তির লকডাউনের দিন

বাসন্তির লকডাউন যাপন

বাসন্তি  বড় আশা নিয়ে গিয়েছিলেন স্বামীর হাত ধরে নয়ডা। প্রায়  চার বছর আগে পাড়ি দিয়েছিলেন কাজের সন্ধানে। গতবছরেই  এসেছিলেন নিজের দেশে। সপরিবারে। তখন কল্পনাও করেনি যে বিপর্যয় এভাবে নেমে আসবে। স্বামী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে মাস পাঁচেক আগে। সামান্য পায়ে ব্যাথা বড় অসুখের আকার নেয়। তারপরে আসে লকডাউনের খাড়া। বাসন্তি ঠাকুর নিজেও ঘরে বসে থাকতে চায়নি। কিছু করার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু ছোটো বাচ্চা রেখে কাজে যাওয়া সম্ভব হয়নি।

স্বামী নয়ডায় সার্কিট কোম্পানীতে কাজ করে। নানা জায়গায় চিকিৎসা করেও স্বামীকে সুস্থ করে তুলতে পারে না বাসন্তী। স্বামী শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে। কোম্পানী যেখানে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে সেখানে উন্নতি না দেখে বাসন্তী নিজেই টাকা দিয়ে ব্যবস্থা করে স্বামীর চিকিৎসার। এইমস এ চিকিৎসা চলে বেশ কিছুদিন। লকডাউনে তা বন্ধ হয়ে যায়। ফরিদাবাদে স্বামীকে নিয়ে যায় এক পরিচিত দিদি। সেখানে স্বামী আটকে পড়ে। এদিকে ছোটো বাচ্চা নিয়ে মহা  বিপদে পড়ে লকডাউনে  বাসন্তী।



বাসন্তী  অকপটে বলে  সংসার  চলে যেত। মেয়ে প্রাইভেট এক স্কুলেও পড়ত। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে আজ এই জায়গায় এসে পড়েছে। নিজের জমানো সব টাকাই স্বামীর অসুখে খরচ করে ফেলেছে। দৈনন্দিন খাবারের জন্য বাইরে পাওয়া রেশনের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। স্বামীর অসুখ ও লকডাউনের সময় খরচ দুটি চালাতে অস্থির বাসন্তী। কোম্পানী কাজে  আদৌ  বহাল রাখবে কী না নিশ্চিত নয় বাসন্তী। স্বামীর  ফিটনেস সার্টিফিকেট জোগাড় হবে কিনা তা নিয়েও নিশ্চিত নয় বাসন্তী। আবার ফিরে এসে নতুন কাজ পাওয়াও অনিশ্চিত। সবমিলিয়ে এক পরিবার নিয়ে বিরাট সংকটে। বাচ্চা সবেমাত্র দ্বিতীয় শ্রেণি।

বাসন্তী বলে, "অনেক স্বচ্ছল পরিবারেও বিভিন্ন রকমের সমস্যা দেখা দিয়েছে। বাচ্চার খাবার  ষ্টক করা যায়নি। সেটা সংগ্রহ করাও খুব কঠিন হয়ে পড়েছে। কাছের দোকান ১,২ সিরিজ ধরে খুলছে। সেখানেও খুব  ভিড়।" বাসন্তীর আক্ষেপ,
লকডাউন এত অতর্কিতে আর এতদিন দীর্ঘস্থায়ী  না হলে স্বামী হয়ত ফিটনেস সার্টিফিকেট জোগাড় করে কাজে যোগ দিতে পারত। একটা পরিবার অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি পেত। এখন স্বামী ফিরবে ফরিদাবাদ থেকে ৯ ই জুন। তারপরে কাজের কি হবে কেউ জানেনা। অল্প সংখ্যক লোক নিয়ে ফ্যাক্টরি চালু হয়েছে। বাসন্তী জানেনা তার স্বামীর ডাক আদৌ পড়বে কিনা। এদিকে সংসারের সবটাই বাসন্তীর হাতের মুঠো থেকে একটু একটু করে বেরিয়ে পড়ছে।  লজডাউন উঠলে স্বামীর ফিরে আসার অপেক্ষায় মুহূর্ত  গুনছে বাসন্তী।

কালনা,পূর্ববর্ধমান।

Tuesday 26 May 2020

জোহরার তালাবন্দির জীবন

জোহরার লকডাউন যাপন 

"কেহু খ্যাতে দিলে খাই। না হয়ত না খ্যায়ে পড়ে থাকি দুইঝনা।" লকডাউনের দিন এভাবেই কেটেছে জোহরার। তবুও জোহরা খুব জোর বেঁচে গেছে। আমপানে বাড়িটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ার কথা। সারা রাত জেগেই কেটেছে জোহরার। সকালে বাড়িটা খাড়া দেখে জোহরা নিজেই অবাক। এই মাটির বাড়িতেই জীবন কেটে গেছে। জানেই না প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার কথা। পাকা বাড়ির স্বপ্ন কোনও দিন তাই মনেই আসেনি। লকডাউনে একদিন আখা জ্বলেছে তো দুই দিন বন্ধ। লকড়ি পাওয়া খুব সমস্যা। নেই ঘরে অন্য জ্বালানির ব্যবস্থা। তবু লকডাউন ও আমপানের দাপট মাথায় নিয়ে বেঁচে গেল জোহরা ও তার মাটির ঘর।

বাড়িতে ছাগল মুরগি পালন করে জোহরা। তা থেকেই আয় হয় জোহরার সংসারের। মুরগির ডিম বিক্রী করে নিয়মিত। সেই থেকে কিছু পয়সা পায়। তা দিয়েই মেটে তেল লবন কেনার খরচ। বাড়ির পোষা ছাগল বিক্রী করে আসে টাকা। সারাবছর এভাবেই চলে। স্বামী বহুদিন থেকেই কাজ করতে পারেনা। বার্ধ্যক্যজনিত অসুবিধে। ছেলে ভিন্ন হয়ে গেছে। মেয়েরা এসে মাঝে মাঝে রান্না করা খাবার দিয়ে যায়। ঘরে চাল আছে। তা সেদ্ধ করার উপায়ও হাতের কাছে নেই। যেদিন জোটে না সেদিন মুখ গুঁজে পড়ে থাকে। লকডাউনে বেচাকেনা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় খুব অসুবিধেয় পড়েছে জোহরা। জোহরা বলে, "সারাজীবন ডিম আর এটা -ওটা বেঁচে এমন করেই চালিয়েছি। ছেলেমেয়ে মানুষ করেছি। লকডাউন শুধু প্রতিদিনের আখাটা জ্বলতে দিল না।" আবাস যোজনায় অনেকের বাড়ির বরাত এসেছে এবারে। দেখা যাচ্ছে, যার বাড়ি আছে তার নামও আরেকবার চলে এসেছে। জোহরার বাড়ির চেহারা বলছে তিনি অন্যতম দাবিদার। কিন্তু তিনি জানেন না তার নাম আছে কিনা! দেখে দেওয়ার মত লোকও নেই তার। জোহরাদের মত যারা উজালা ও আবাস যোজনার আওতায় এলো না তাদের কি হবে? সারাজীবন পাতা-কাঠ জোগাড় করে দিয়ে রান্না করে যাবে? একটা পাকা বাড়ি ও সিলিন্ডারের স্বপ্ন নিয়ে জীবন কেটে যাবে? এদের জন্য ব্যবস্থা করা যাদের কথা ছিল তারা দুর্দিনে দুই কেজি চাল ও একটি তেলের বোতল দিয়ে বিশ্বাস অর্জন করে নিল। কিন্তু গনতান্ত্রিক অধিকার ও সরকারি ঘোষণা সুবিধে পাওয়ার জন্য যে সামর্থ্যটুকু প্রয়োজন সেটাই অর্জন করলো না। এদের সূযোগ পাওয়ার জন্য ফর্মটাও কেউ দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে এসে ভরে দিল না। গ্রাম স্বরাজের আদর্শের তলায় চাপা পড়ে থাকল জোহরাদের দীর্ঘশ্বাস। কুলগাছি,শেখপাড়া ,ভগবানগোলা ১

Sunday 24 May 2020

অভিবাসী শ্রমিক কাকলীর তালাবন্দির দিন

 কাকলীর লকাউন যাপন

বাড়ি ফিরতে অভিবাসী শ্রমিক কাকলীকে ধার করতে হয়েছে দশ হাজার টাকা। বাসে দিল্লি থেকে রায়গঞ্জ। মা ও ছেলের ভাড়া দশ হাজার টাকা। সেখান থেকে আরও তিনশো টাকা ভাড়া দিয়ে বহরমপুর ফেরা। কাকলি গৃহপরিচারিকার কাজে যায় দিল্লি। সেখানে নিজের চব্বিশ বছরের ছেলেকেও ডেকে নেয়। ছেলের মাত্র দুই দিন কাজ করার পরেই লকডাউনের ঘোষণা দেয়। এদিকে লকডাউনের জন্য শেষ মাসের কাকলীর  মাইনেও বাকি থেকে যায়। হাতে পর্যাপ্ত নগদ টাকা না থাকায় কাকলিকে পালিয়ে আসতে হয়। ওখানে থাকলে অনাহারে কাটাতে হবে। বাড়ি ফিরে এলে অন্তত আত্মীয় পরিজনের কাছে সাহায্য পাওয়া যাবে। সেই ভরসায় টাকা পয়সা ধার করে বাড়ী আসা। এখন হোম কোয়ারান্টাইনে আছে মা -ছেলে। ইদে একদম খালি হাত। ঘরে বন্দি। খাবার নেই। আত্মীয়রাও দেখা করতে আসতে পারছে না। খুব অসহায় হয়ে পড়েছে কাকলী। অভাবের তাড়নায় ঘর ছেড়েছিল। কিন্তু নতুন অভাবের ভার  নিয়ে ফিরল বাড়ি। খুশির ইদ বিষাদে ভরল। না মিলল বখশিস। না মিলল নতুন জামাকাপড়।  কাকলির আপশোস, "জোয়ান ছেলেটা ঘরে পড়ে রইল। ছেলেটার  তো ইদ ভালো করে পালনের কথা ছিল । কিন্তু এত টাকা ধার  করে এমন মন খারাপ যে আমাদের আর ওঠার ক্ষমতা নেই।"



এই দেশের দ্বিতীয় জনপ্রিয় পেশা এই পরিচারিকার কাজ। এদের ছুটি ও অসুস্থতা নিয়ে নেই আলাদা  কোনও ব্যবস্থা। সারাবছর জাঁতাকলে পিষ্ট। মাসের প্রথম দিনে মেলে না মাইনেও। সবটাই বাড়ির মালিকের উদারতা ও ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। অনলাইন এজেন্সি এখন কাজের মেয়ে খুঁজে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছে। জায়গাভেদে গৃহ কাজ ও বেবি সিটার অনলাইনের মাধ্যমেও বুক করা যায়। সিটি গুলিতে সারাদিনের মেইড নেয়  নয় হাজার থেকে  এগারো হাজার। দিনের অর্ধেক সময় কাজ করলে পায়  ছয় থেকে আট হাজার টাকা।  কিন্তু  কাকলীদের মত পরিচারিকাদের খুব কম টাকায় কাজ করতে হয়। বার বার কাজও ছাড়তে হয়। ছেলের অসুখ বা বাড়ির মেরামতির জন্য দুই দিন না গেলেই কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়।  আবার মালিকের মুখের উপর জবাব দিলেও ছাড়তে হয় কাজ। শীতের পোশাক ও বর্ষার ছাতার জন্য  অনেক মুখ ঝামটা সইতে হয়েছে তাকে। বিপদ কাটিয়ে সকালে হাজির হতেই জেনে গেছে  কাজটা তার চলে গেছে। পরে এসে পয়সা হিসেব করে নিয়ে  যেতে বলা হয়েছে। ব্যবহার করতে দেওয়া হয়নি পরিবারের বাথরুম। এই রকম  প্রভু-ভৃত্যের অবস্থান থেকেই কাকলী পালাতে চেয়েছিল। পয়সা আর সম্মান দুটোই যখন নেই তখন দেশের মাটি কামড়ে পড়ে থাকা কেন? তাই কাকলী পাড়ি দেয় দিল্লির অচেনা মাটিতে। কিন্তু কপাল সঙ্গ দিল না। লকডাউন ভাগ্যের রেখা বদলাতে দিল না।

কাকলী বলে, নিজের দেশে অনেক শিক্ষিত বাড়িতে কজ করেছি। কিন্তু সম্মান কোথাও  সেভাবে পাইনি। বাইরে সম্মান না থাকলেও টাকাটা বেশী  তাই ছুটেছিলাম। মা-ছেলে কাজ করে ভেবেছিলাম দিন বদল হবে। কিন্তু কাজের মেয়েদের কি তাই হয়? শিক্ষিত মানুষেরাই তো ভালবাসতে পারল না আমাদের । আমাদের এখনও
 অনেকে ছোটোলোকই ভাবে!  ঘর মুছি,বাসন মাজি কিন্তু কোনোদিন ও নিজের ডাইনিং টেবিলে বসে খেতে বলেনি কেউ। এমনকি যে সোফা প্রতিদিন ঝাড়ি-মুছি সেখানে বসতেও দেয়নি একদিন।  মার্বেলের বাথরুম পরিষ্কার করি কিন্তু একদিনও স্নান করতে দেয়নি কেউ। 

কাকলি দুঃখ করে বলে, " মান -সম্মান আমাদের নেই এটাই সবাই ভাবে। কাজের  অনুপাতে মূল্য পায় না সয়ে যায়। কিন্তু মানুষ হয়ে মানুষকে ছোট করে সেটাই খারাপ লাগে। অভাব তো আমাদের চিরকাল। লকডাউন শুধু ধার বাড়িয়ে দিল। হাত পাতা ছাড়া উপায় রাখল না কোনও।"

বহরমপুর ,মুর্শিদাবাদ।

Thursday 21 May 2020

অভিবাসী শ্রমিক প্রতিমা মোদকের তালাবন্দির দিন

 প্রতিমা মোদকের লকডাউন যাপন

চার ক্লাসে পড়া ছেলেটার মুখে খাবার তুলে দিতে পারছেনা প্রতিমা মোদক। কাজের সন্ধানে একদিন ঘর ছেড়ে পাড়ি দিয়েছিল। দিনহাটা থেকে উত্তরপ্রদেশ। মাস আনে মাস খায়। উপার্জনের টাকায়  চলে বাড়ি ভাড়া ও দৈনন্দিন খরচ। আট বছরের বেশি  সময় ধরে স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে বাস নাংলা চরনদাস,নয়ডায়। সংসারের অভাবের কথা ভেবেই লকডাউনের আগে মেয়েকে নিয়ে বাবা  ঘরে ফিরে আসে। ছেলে পাঁচ ক্লাসে ভর্তি হবে তাই মা ছেলেকে নিয়ে থেকে যায়! সেলাই ও  সুতো কাটিং করার কাজ ছিল প্রতিমার। দুই মাস ফ্যাক্টরি বন্ধ। এবার খাওয়ার টান। স্বামীও বেকার বসে  দেশের বাড়িতে। প্রতিমা একমাত্র ভরসা পরিবারে।

কোথায় কারা খাবার দিচ্ছে খুঁজতে খুঁজতে দিন কাটছে প্রতিমার। সন্ধ্যের আগেই এগারো বছরের ছেলেটাকে খাবারের পাত্র নিয়ে রাস্তা রাস্তা ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে। প্রতিমার কষ্ট সেটাই।বাড়ি ভাড়া ২৫০০ টাকা প্রতিমাস। সেটা টানতেই এখন  হিমশিম খাচ্ছে প্রতিমা। প্রায় চল্লিশ ছুই। শুনেছে কোম্পানী ছাঁটাই করবে। আর কি কাজ পাবে কোথাও নতুন করে? এদিকে ছেলের তো ক্লাস ফাইভ হবে এবার। প্রতিমা মোদক বলে, "এখন দুই বেলা দুমুঠো খাবারের বাইরে আর কিছুই ভাবতে পারছিনা।কাজ থাকবে কি? জানিনা। ছেলেটাকে তো বাঁচিয়ে রাখতে হবে।"



প্রতিমার বাবা কৃষিকাজ করতেন। চাষি পরিবারে মেয়ে।পড়ালেখা শেখাই হয়নি। নিজের মেয়েকেও অভাবের কারণে  টানতে পারেনি প্রতিমা। পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যায়। বাপ - মা বাইরে খাটে তাই মেয়ে ঘর সামলায়।  অচেনা জায়গায় ঘরে বসে পরিবার ও ভাইকে দেখাশুনা করতে গিয়ে মেয়েটাও এগোতে পারে না। তারপর  ছেলেকে মানুষ করার ভূত মাথায় চাপে প্রতিমার। দিনরাত এক করে তাই কাজ করেছে প্রতিমা। কে জানত লকডাউন এভাবে  পরিবারটাকেই রাস্তায় এনে ফেলবে! হাত খালি করে দেবে। প্রায় সাত হাজার টাকা বেতনের চাকরি পেয়েছিল  প্রতিমা। পি এফ ও নাকি কাটত কোম্পানী। কাজ চলে গেলে কি সে টাকা পাবে? চিন্তায়  রাতে ঘুমাতে পারছে না প্রতিমা।  জেগে জেগেই সকাল হয়ে যাচ্ছে। বাড়িতেও বাবা -মেয়েও খালি হাতে ফিরেছে। তাদেরও প্রতিমা কিছু সাহায্য করে উঠতে পারছে না। 

সবমিলিয়ে জীবন নিয়ে বেঁচে থাকাই দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে। একে নিজের দেশ নয়। অন্যদিকে কাজ নেই। হাতে পয়সা নেই।  খাবার কেনার ক্ষমতা নেই। এভাবে আর কতদিন!
আমপাড়া,দিনহাটা,কুচবিহার

Wednesday 20 May 2020

ক্যাটারিং ব্যবসায়ী পূর্ণিমা মণ্ডলের লকডাউনের দিন

ক্যাটারিং ব্যবসায়ী পূর্ণিমা মন্ডলের লকডাউন যাপন
কয়েকটা  বিয়ে ও একটি জন্মদিনের অর্ডার ছিল ক্যাটারিং এর। অনুষ্ঠান বাতিল হয়েছে লকডাউনের জন্য। বাকি  তিনটি  হয়ে যাওয়া অনুষ্ঠানের টাকা পাওয়া গেল না। সকলেই  "পরে দিচ্ছি" জানিয়ে দিল। ব্যবসায় টাকা ফেঁসে যাওয়ার যে  কি বিষ তা হাড়ে হাড়ে টের পেলেন ক্যাটারার ব্যবসায়ী পূর্ণিমা মন্ডল। মাত্র  তিন বছরের ব্যবসা একটু মাথা  তুলতেই নুয়ে পড়ল যেন! বন্ধ হওয়া অনুষ্ঠানের জন্য আগাম কিছু টাকাও খরচ হয়ে গিয়েছিল। সেই টাকা আটকে রইল। আবার নতুন করে অনুষ্ঠানের দিন কবে স্থির হবে একদম অজানা পূর্ণিমার। জীবনের নানা ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে একটু স্থিতু হয়েছিল পূর্ণিমা। স্বামীকে কিনে দিয়েছিল টোটো। ক্যটারারের ব্যবসায় নিজের ভাই ও স্বামীকে সঙ্গে নিয়েছিল। নিজের ক্যাটারিং এ যুক্ত  কর্মীর কাপড় কেচে দেওয়া ও হিসেবের খাতা দেখার জন্য লোক রাখেনি আলাদা করে। কিছুটা খরচ কমানোর ইচ্ছে থেকেই নিজেই দুই  হাতে কাজ করেছে এতদিন। কোথাও কোনও ঘাটতি রাখেনি সততার। ক্যাটারিং এর ব্যবসা ছিল পূর্ণিমার নিজের পরিবার।

ব্যবসা শুরুর  মাত্র বছর  দুই আগেই  পরিস্থিতি ছিল অন্যরকম। একদিন চুপিচুপি  স্বামী ও মেয়েকে নিয়ে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয় পূর্ণিমা। অভাবের সামনে পড়ে দিশেহারা হয়ে যায় । টানা ছয় মাস কোনো কাজ নেই স্বামীর হাতে। স্বামীও সায় দেয়। তিনজনেই বিষ খাবে। স্থির হয়। কিন্তু ভোর হবার আগেই বদলে ফেলে সিদ্ধান্ত। নিজেদের জীবনের মূল্য হারালেও মেয়ের প্রাণ বাঁচানোর দায় থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারে না পূর্ণিমারা। দুর্দিনে না খেয়ে থাকা থেকে শুরু করে  তিনজন তিনটে আলু সেদ্ধ খেয়েও দিন কাটিয়েছে। তারপরেও  চরম  অভাবের দিনে মেয়ের মুখের হাসির দিকে তাকিয়ে এই মন্ডল দম্পতি সিদ্ধান্ত বদলাতে বাধ্য হয়। নতুন সকালে নতুন করে শুরু করে পূর্ণিমারা। মেয়েকে মানুষ করার অদম্য আকাঙখা থেকে আবার যাত্রা শুরু। মেয়ের স্বপ্নে  বাবা-মায়ের নতুন সফর শুরু হয়। বেঁচে থাকার নতুন ইচ্ছা জাগে।



অষ্টম পাশ পূর্ণিমার স্বচ্ছল ও শিক্ষিত পরিবারেই বিয়ে হয়। কিন্তু স্বামী একটু বেপরোয়া হওয়ায় নানা জটিলতার মধ্যে দিয়ে দিন কাটে।  বাড়তি ঝামেলা এসে পড়ে একের পর এক। স্বামীর সাজা হয়ে যায়। জেল থেকে নিজের হাতে ছাড়িয়ে নিয়ে আসে। একা লড়ে যায় পূর্ণিমা। কিছুতেই হার মানে না । নিজের সব উজার করে  সংগ্রহ করে ক্যাটারিং এর ব্যবসার জন্য টাকা। ঋণ করে  নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে। তারপর স্বামীকে নিরন্তর উৎসাহ দেয়। ব্যবসায় গতি আসে। স্বামীর টুকটুক থেকেও আয় হতে থাকে টাকা। সবমিলিয়ে খুব সাফল্য আসে পূর্ণিমার নতুন ব্যবসায় ও পরিকল্পনায়।

লকডাউন লিখে দিল কপালে নতুন  বিপর্যয়। টুকটুক ঘরে  বসে থাকল দুই মাস । লকডাউনে অনুষ্ঠান একের পর এক বাতিল হল তাই  টাকা আটকে  থাকল। হাত হয়ে গেল  ফাঁকা। আরপরে লোনের মাসের টাকা মিটিয়ে  টাকা শেষ। নগদ টাকা কি করে যে হাতে ফিরে আসবে এবং  কখন তা নিয়ে একদম অন্ধকারে পূর্ণিমা। পূর্ণিমা বলে, "কি সংগ্রাম করে এই ব্যবসা করা,স্বামীকে বেঁচে থাকার পথ দেখানো বলে বোঝাতে পারবো না। জীবনের আশা যে ছেড়ে দেয়, তাকে জীবনে ফেরানো যে  কী কঠিন,সে আমিই জানি।" 

পূর্ণিমা বলে, "আমার  মত অনেকেরই সামনে কঠিন দিন আসছে। জানিনা কি করে কি হবে। আসলে টুকটুকটা চললে হয়ত কিছুটা সামাল দেওয়া যেত সংসার। লকডাউন এভাবে সুখের দিনে আগুন লাগিয়ে দেবে কল্পনাও করিনি।" পূর্ণিমা  বলতে শুরু করে মেয়ে আর স্বামী নিয়ে কিভাবে ব্যবসাটা মেয়ের নামেই শুরু করেছিল । অনেকটা সামনের দিকে এগিয়েও গিয়েছিল। এখন থমকে। আগামীতে শুধু অনিশ্চয়তা আর অন্ধকার। 

অন্যমনস্ক পূর্ণিমা বলে,"এত বছরের দাম্পত্যের সুখ শান্তি কেড়ে নিয়েছে এই লকডাউন। একটিই জীবন,কতবার শুরু করা যায়!"
ভাকুড়ি,মুর্শিদাবাদ

Monday 18 May 2020

অভিবাসী শ্রমিক সন্ধ্যারানির লকডাউনের দিন

 সন্ধ্যারানি সাঁতরার লকডাউন যাপন 
কারা যেন খাবার বিলি করছে শুনে ছুটে যায় সন্ধ্যা সাঁতরা। বাটি নিতে ভুল হয়ে গিয়েছিল সন্ধ্যার । আবার মাঝরাস্তা থেকে ফিরে আসে। এবারে বাটি নিয়ে  লাইনে দাঁড়াতেই  খাবার শেষ। সন্ধ্যার আজ আর খাবার জুটল না। নন্দীগ্রামের সন্ধ্যারানি সাঁতরার জীবনটাই একটা উপন্যাস। লকডাউনে পাতা গুলো উল্টেপাল্টে বেরিয়ে এল। স্বামী মারা গেল  কুড়ি বছর আগে। বাপের বাড়ি ও শ্বশুরবাড়ির সবাই মুখ ফিরিয়ে নিল। সোজা নন্দীগ্রাম থেকে পাড়ি দিল উত্তরপ্রদেশের নয়ডায়। জলপাই থেকে  গৌতম বুদ্ধ নগর এর সফরটা খুব সহজ ছিল না।  নানা জায়গায় কাজ করে অবশেষে ভাগ্য খুলে যায় সন্ধ্যার। একটা রেডিমেট গার্মেন্টস কোম্পানীতে কাজ পায় সন্ধ্যা। নতুন কাজে খুব ভালো চলতে থাকে সব। আড়াই হাজার টাকা দিয়ে ঘর ভাড়া নেয় সন্ধ্যা।  ছুটি না নিলে আয় হতে থাকে মাসে আট হাজার টাকা। লকডাউনের আগেই উনিশ দিনের টাকা দিয়ে দেয় কোম্পানী। সেই টাকা দিয়ে ঘর ভাড়া ও সংসার চলে যায় সন্ধ্যার। এবারে সমস্যার শুরু। সন্ধ্যা আর চালাতে পারছে না। প্রতিদিন বাটি হাতে লাইন দিয়ে খাবার নিতে যাচ্ছে। কোনোদিন পাচ্ছে। কোনোও দিন পাচ্ছে না। মুশকিল হল লকডাউনে কোম্পানী খুলেছে কিন্তু সন্ধ্যার ডাক পড়েনি। খুব অল্পসংখ্যক কর্মী নিয়ে ফ্যাক্টরি কজ চালাচ্ছে। সন্ধ্যা বড় আশা নিয়ে প্রতিদিন যাচ্ছে আর ফিরে আসছে। সন্ধ্যা কেঁদে বলে, "সব দুঃখ সহ্য করেছি, লাইনে দাঁড়িয়ে হাত পেতে খাবার নিচ্ছি। আমার এই একযুগ ধরে খেটে খাওয়ার জীবনে এমন খারাপ সময় দেখিনি।"



সন্ধ্যা  মাত্র চার ক্লাস পাশ  করেছিল।  স্বজন হারিয়ে বিদেশে এসে বাস করছে।  বাংলায় কথা বলার কেউ নেই।  নিজের খেটে খাওয়ার উপর ভরসা ছিল।  তাই কখনও ভয় পায়নি। এখন খুব উদ্বেগের সঙ্গে দিন কাটছে।  খাবার নেই, চেনা লোক নেই। একা ও অসহায় হয়ে পড়েছে সন্ধ্যা। নিজের উপার্জনেই মেয়ের বিয়েও দেয়। যাবতীয় সাংসারিক দায়িত্ব মাথায় তুলে নিয়েছে একের পর এক। এখন নিজের কাছেই নিজে বোঝা হয়ে গেছে। ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলছে। কাজটা যদি ফিরে না পায় সেই আশঙ্কাও মাথায় চড়ে বসেছে। বয়স পেরিয়েছে পয়তাল্লিশ। আর কি কাজ পাবে কোথাও? মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে সন্ধ্যার। সন্ধ্যারানি সাঁতরা কাজ ছেড়ে মেয়ের কাছে থাকবে সে ইচ্ছাও নেই। জামাই এর বোঝা হতে চায় না। বাড়ি ভাড়া গত দুই মাসে মিটিয়েছে। আগামীতে কি হবে জানেনা সন্ধ্যা। 

এই লকডাউনে সন্ধ্যার মত মহিলাদের  সম্মান নষ্ট করে দিল। নিজের উপার্জনের অহংকার কেড়ে অন্যের সহানুভূতি ও দয়ার পাত্র করে দিল। সন্ধ্যা আপশোস করে, "নিজের জোরেই কাজ খুঁজেছি, নিজের জোরেই পড়ে আছি বাইরে কিন্তু এই লকডাউনে পরভরসা হয়ে গেলাম।" 

সন্ধ্যার ফেরার পথ নেই ঘরে। ওখানে রুজি-রুটির অনিশ্চয়তা এনে দিয়েছে লকডাউন। কাজ করা খেটে খাওয়া মেয়ের থেকে মুখ ঘুরিয়েছে অনেক আগেই আত্মীয় -পরিবার। এখন এক অনিশ্চিত জীবনের সঙ্গে ঘর। সন্ধ্যা ভাঙা গলায় বলে, "একটু সাহায্য করবেন?" একথাটা বলতে গিয়ে গলা বন্ধ হয়ে আসে সন্ধ্যারানি সাঁতরার।  কষ্ট করে বলে, "জগতে মেয়েদের জন্য সবকিছু খুব কঠিন।"
 জলপাই,নন্দীগ্রাম,পূর্ব মেদিনিপুর।

Friday 15 May 2020

গামছা বুননের কারিগর আসমা ও বৃষ্টি মন্ডলের লকডাউন যাপন

আসমা ও বৃষ্টির লকডাউনের দিন

এখন ঘরে কুড়ি কেজি চাল। শাক-পাতা তুলে নিয়ে চলছে হাঁড়ি। রান্না তেল ছাড়াই। আখার জ্বালানি বলতে  পড়ে পাওয়া শুকনো পাতা ও লকড়ি। আসমা মন্ডলের সংসারে লকডাউন এভাবেই থাবা বসিয়েছে। গামছা বুনে আয় হত মাসে তেরোশো টাকা। সেই টাকাতেই দুই মেয়ে নিয়ে সংসার আসমার। স্বামী  অসংগঠিত শ্রমিক। মাঝে মাঝে কাজে যায়। ফিরে আসে হাজার - বারোশো টাকা নিয়ে। লকডাউনের আগে নিয়ে এসেছে মাত্র ছ'শো টাকা। সংসারের ভার আসমার উপরেই ছিল বরাবর। লকডাউনের ঘোষণায় বন্ধ হয়েছে  গামছার কাজ। এদিকে ছাদ  থেকে পড়তেই আছে বৃষ্টির জল। মেরামতের নেই সামর্থ্য। লকডাউন চলছেই। নিরুপায় হয়ে  তুলে দিতে হল  ঘরে বসানো গামছা বুননের তাঁত।


   
বাড়িতে অভাবের কারনে বৃষ্টির স্কুলের মুখ বেশিদিন দেখা হয়নি। দ্বিতীয় শ্রেণিতেই ইতি টানতে হয়। মায়ের সঙ্গে গামছা বুনানোর সহযোগিতায় পেরিয়ে যাচ্ছে শৈশব ও কিশোর বেলা। আসমার লোক দিয়ে পয়সা রাখার মত আর্থিক ক্ষমতা ছিল না। তাই দুই মেয়েকেই উপার্জনের কাজে  লাগাতে হয়। খিদে মেটাতে বিদ্যালয়ের হাতছানি উপেক্ষা করতে হয় বৃষ্টি ও সাগরিকাকে। পরিবারের পেট চালাতে দুই মেয়ে শিক্ষিত হতেই পারল না! আসমা কষ্ট পেয়ে বলে,"দুই মেয়ে আর আমি মুক্ষু-সুক্ষু থাকলাম। জন্ম থেকেই অভাব। তারপর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। আবার সেই  অভাবের সঙ্গেই ঘর।" 

সারাবছর প্রায় তেল ছাড়াই চলে রান্না তা নিয়ে কষ্ট নেই আসমার। মেয়েকে বিদায় করতে হল এই লকডাউন ঘোষণার সময়। সে নিয়ে জ্বালা আছে আসমার । দুই মেয়েকে ঘরে সামলে রাখার জন্য যে ঘর চাই সেটাও তার নেই। আসমা বলে "বাপ তো প্রায় থাকে না । আমি একা কত দেখবো। কিছু হয়ে গেলে কে দেখবে? তাই চেষ্টা করছিলাম বিয়ে দেওয়ার। আসমা বলে,"খাবারের অভাব। ভাঙা বাড়ি। মেয়েকে আগলে আর কদ্দিন রাখতে পারবো? একটা মাথা কমে গেলে হাঁড়িতে চালও কম লাগবে। শ্বশুরবাড়িতে নিরাপদ থাকবে।  

প্রান্তিক জীবনের এই আর্থিক দুঃখ-দুর্দশা অন্তহীন। জরাজীর্ন বাড়ি,ভেঙে পড়া ছাদ,মলিন শাড়ি, জানালায় অত্যন্ত সুনিপুন হাতে সেলাই করা চালের বস্তার পর্দা- এসব কিছুই এই রুক্ষ চুলে ছিপছিপে রোগা চেহারার আসমাকে পরাস্ত করতে পারেনি। নিঃস্ব জীবন কিন্তু নিরানন্দ নয়। পায়ে ছিঁড়ে যাওয়া চটি কিন্তু অভিযোগ নেই কোনও। হাতে পাঁচ টাকা নগদ নেই । কিন্তু অনাহারে ভয় নেই।  এই সরল মানুষ গুলো সবার আগে গিয়ে লাইন দিয়ে ভোট দেয়। গণতান্ত্রিক সরকার গঠনে এদের বিনোদন বিহীন সততা সবচেয়ে বেশি। কিন্তু একপুরুষ তারপর দুইপুরুষ চলে যায় এদের জীবনে আড়ম্বর ফেরে না। এদের ঘামের গন্ধ ভালোবাসা সম্বলিত ভাষণ দিয়ে চোখ জুড়ানো পোশাকে দেশনেতা সমাপ্তি টানেন। আর ওই টিলার উপরে একখান ঘরে অনাহার,রোগ নিত্যদিন ঘর বাঁধে। হাঁড়িতে ভাত না থাকার সত্যটা কেমন যেন গল্পের মত শোনায়। লক্ষ -কোটি টাকার যোজনা ও পরিকল্পনার হুংকারে চাপা পড়ে যায় আসমাদের বাদ ছেঁড়া অর্ধেক  হাওয়াই চটির বাস্তব। ঢেকে যায় ভেঙেপড়া ছাদের মধ্যে দিয়ে ঢুকে পড়া জলের রাতে বৃষ্টি দিয়ে ভাত মাখানোর দীনতা। লকডাউনের দিনে বৃষ্টিই তরকারীর অভাব পূরণ করে আসমা মন্ডলের সংসারে। যে যেখানে দাঁড়িয়ে আসমাদের দেখে। এবং  ভুলেও যায়। কিন্তু চোখের কোন থেকে আসমা-সাগরিকা-বৃষ্টিদের  বিশ্বাসের রেখাটা কিছুতেই মিলিয়ে যায় না!         
 
হরিহরপাড়া,তর্তিপুর,মুর্শিদাবাদ
 

Wednesday 13 May 2020

সোনালি হাজরার তালাবন্দির দিন

 সোনালির লকডাউন যাপন

"সরকার এত সাহায্য দিচ্ছে শুনছি। কিন্তু আমাদের লোনের এই তিনমাসের  টাকাটা মুকুব করে দিতে পারে না?" সোনালি  হাজরার এখন এটাই জিজ্ঞসা। পনেরো বছর ধরে সোনালি পাটের ব্যাগ ও ম্যাট তৈরি করে। লকডাউনের জন্য ঘরে পড়ে থাকল প্রায় হাজার তিরিশের  তৈরি জিনিষ। কলকাতায় মেলাতে যাওয়ার জন্য তৈরি ছিল বাড়তি মাল। সেটাও বাতিল হয়েছে। তাই ব্যাগ, ম্যাট যাবতীয় জিনিষ ঘরবন্দি। পাইকারী বিক্রীর উপায়ও বন্ধ। প্রতিদিন দলের মেয়েদের অভাব-অভিযোগ শুনে একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে সোনালি। নিজের পরিবারে অশান্তি কি কম! স্বামী লেবার। তিন জায়গায় অন্তত বারো হাজার টাকা পাবেন। কিন্তু হিসেব করেও পেলেন না টাকা। এখনও দিচ্ছি ও দেবো চলছেই।



বিয়ে করে  সোনালি এসেছিল পাকা ঘরে। শাশুড়ি স্বনির্ভরগোষ্ঠীর দৌলতে গেঁথে ফেলেছিল ইটের দেওয়াল। কিন্তু সেই ঘরে অভাব কখনও এসে পড়বে ভাবেনি সোনালি। ঘরে রেশনের  চাল আছে। আটাও আছে। বাকি কিছু কেনার ক্ষমতা নেই। সোনালি আপশোস করে বলে,"ইটের দেওয়াল থাকলে কি অভাব থাকে না দিদি? গ্যাসের পাশে যে আখার উনুন সেটাও খুব বড় সত্যি। পঞ্চাশ দিন বাড়িতে বসে। আমার কাজও বন্ধ অনেকদিন। টাকা কোথায় পাবো?"

সবিতার ছোট ছেলে মাত্র দ্বিতীয় শ্রেণি। সে তো কিছু বোঝে না। নবম শ্রেণির বড়টা একটু অবস্থা বুঝলেও ছোটটি একেবারে অবুঝ। তাই প্রতিদিন খাবার নিয়ে অশান্তি চলছেই। তাতে সোনালি খুব বেশী বিব্রত নয়। কিন্তু গোষ্ঠীর মেয়েরা উপকৃত হলেও আসল উদ্দেশ্য থেকে অনেকেই সরে আসছে। এই নিয়ে সোনালি বেজায় ভাবিত। গোষ্ঠীর অনেক মেয়েই যে ঋণ নিচ্ছে তা দিয়ে মেয়ের বিয়ে দিচ্ছে। নইলে সংসার চালাচ্ছে। টাকা জীবনের কাজে লেগে যাচ্ছে। জীবিকায় সক্ষমতা ও বাড়তি আয় বাড়ানোর কাজটা বাকি পড়ে থাকছে। তাই সামাজিক পরিবর্তন ও গ্রামের উন্নতির ভাবনা অনেকটাই পেছনে পড়ে রয়েছে। 

সোনালি বলে,"স্বনির্ভরতা ও সক্ষমতা আর এক কথা নেই গো দিদি! সরকার যাদের স্বনির্ভর করার কথা বলছে তারা কি সক্ষম হতে পেরেছে? আজ আমি তো সক্ষম নই! এমন অবস্থা চলতে থাকলে আমাকেও কাল অন্যের সাহায্যে নিয়েই বাঁচতে হবে। সম্মানের আড়াল আর থাকবে না! কিন্তু আমি তো খেটেই খাই।" 

লকডাউনের মত পরিস্থিতি সোনালিদের অভাবি বানায়। তাই এই অসময়ে সরকারের কাছে হাত পাতা ছাড়া আর কি করতে পারে সোনালিরা ? সোনালি বলে, "অসময়ে সম্মান বাঁচানোর জন্য যদি গোষ্ঠীর মেয়েদের কোনও পলিসি বা বীমার আওতায় এনে ফেলত তবে মুখ রক্ষা হত।সারাবছর খেটেও যদি ধার করে খাই বা শোধ দিতে না পারি কেমন লাগে বলুন?"

সোনালির এই খারাপ লাগা একার নয়। লকডাউনের জন্য  স্বনির্ভর গোষ্ঠীর অনেক মেয়েদের এই  খারাপ লাগা নিয়ে চলতে হবে আগামী দিনে। মাসের মিটিং এবং  হিসেবের খাতা সব বন্ধ পড়ে। ফিল্ডে পড়ে আছে অনেক টাকার জিনিষ। ডেলিভারী না দিতে পারলে আবার সেই নতুন  ঋণের ফাঁদ। আবার সেই শোধ করতে না পারার হাহাকার। আবার সেই অক্ষমতার গল্প প্রতিদিন বারান্দা-চৌকাঠ জুড়ে।     
হাজরাপাড়া ,ইসলামপুর,মুর্শিদাবাদ     

Tuesday 12 May 2020

রেফুল রুপেন,পানফুল দাদির তালাবন্দি জীবন

 দাদিদের লকডাউন যাপন
  
এই লকডাউনে সেহেরি আর ইফতারের মাঝের দৈনন্দিন জীবনটুকু গায়েব হয়ে গেছে তিন দাদির। শ্যুটার চন্দ্র আর প্রকাশ তোমর দাদিদের মত রেফুল,পানফুল, রুপেন দাদিরা মাথা তুলতে পারেনি। ওদের নিয়ে তাই 'ষান্ড কি আঁখ' এর মত সিনেমাও তৈরি হবে না। গল্প লেখাও হবে না। শাহিনবাগের দাদিদের মতও ঘর ছেড়ে রাস্তায় প্রতিবাদে শামিল হওয়া হয়নি রেফুল দাদিদের। এই দাদিরা গ্রামের এক এক প্রান্তে পড়ে থেকে অস্তিত্বের লড়াই লড়ছেন। কাজে বিড়িশ্রমিক। পরিচয়ে দাদি। প্রায় দুই যুগ ধরে স্বামীর ভিটা আগলে। ছেলেরা নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। বাপের ভিটাতেই আলাদা হয়ে থাকতে হচ্ছে মাকে। লকডাউনেও মায়ের মুখে একটুকরো রুটি তুলে দেয়নি ছেলেরা। মাও নাছোড়। ভিটাতেই ত্রিপল টাঙিয়ে পড়ে রয়েছে এক কোনায়। বিধবা ভাতার কথা শুনে হাসিই থামে না কানফুল দাদির। বলে "দুইবার না তিনবার ভাতা পেয়েছিনু কিসের জানিনা! ২৫ বচ্ছরের বিধবা আমি। পায়সা আছে এত সরকারের হামারঘে পুষার।"

রেফুল দাদির স্বামী দুই বছরের বাচ্চা রেখে মারা গেছেন। দীর্ঘ পঁচিশ বছর দাদি একাই সামলেছে সব। ছেলে বিয়ে করে মায়ের হাড়ি ভিন্ন করে দিল। মাটি কামড়ে ভিটাতেই পড়ে রইল দাদি। লকডাউনের দুর্দিনে ইফতারে মাকে ভিজা ভাত খেতে দেখেও ছেলে ছুটে আসে না একটিবার। তারপরে ছেলেকে বাপের ভিটা ছেড়ে দিয়ে মায়ের ভিটাতে আশ্রয় নিল রেফুল দাদি। দাদি বলে,"বিড়ি ইচ্ছা হলে বাঁধি,চোখে দ্যাখতে পাই না। বাদ চলে যায় বিড়ি। পায়সা কেটে নেয় মুন্সির লোক।" চোখে জল নিয়ে দাদি বলে " ভালো-মন্দ খ্যাতে দেয় না কেহু। তাতে কি জান আটকাবে? চেহে -চিন্তে চলছে। পায়সা নাই ওষুধের, জল -পানি মিলে না সবসময় তাও গরীবের ধক বেশি।"



কানফুলের স্বামী নাই কুড়ি বছর। বিড়ি বেঁধে যে ছেলেকে মানুষ করা সেই ছেলে ভিন্ন করে দিল মাকে। সুগার, প্রেসার নানা অসুখে জেরবার পানফুল দাদি। ছেলে হাঁড়ি আলাদা করতে বললে মানে লাগে কানফুলের। অভিমানে বিড়ির কুলায় বসে বিড়ি বাঁধতে বাঁধতে ঘুমিয়ে পড়ে। কতটুকুই বা খেতে পারে সে! বলে, "সারাজীবন একা থাকলাম ছেলে বুকে করে। কিন্তু সেই ছেলেই ছুঁড়ে ফেলে দিল। আজ এই বিপদেও পাশে কেউ থাকল না।" কানফুল দাদি বলে, "তাই বলে কি হাত গুটিয়ে লুকিয়ে যাবো? লকডাউনেই বাড়ী বাড়ী ঘুরে কিছু না কিছু পেটের জোগাড় করে আনি প্রতিদিন।"



রুপেন দাদির স্বামী তিন বছরের ছেলে রেখে মারা গেল। প্রায় ২৪ বছর ধরে একা হাতে ছেলেকে মানুষ করলেন দাদি। বিড়ি বেঁধেই সংসারের হেঁশেল বাঁচল। বিয়ে করে ছেলে ভিন্ন করে দিল মাকে। এতদিনের সংগ্রাম এক নিমেষে মিশে গেল মাটির সঙ্গে। তীরে এসে তরি ডুবে গেল রুপেনের। সুখের দিন দেখার কথা ছিল। ছেলে বড় হয়ে মাকেই দেখবে এটাই তো প্রকৃতির নিয়ম। হল না।



এই দাদিরা অত্যন্ত কম বয়সে মা হয়েছেন। দাদি হয়ে পরের প্রজন্ম তাদের ছুঁড়ে ফেলার বাইরে কিছুই করল না। দাদিরা জীবনের সব ধর্ম পালন করেলেন বীনা প্রশ্নে। শুধু প্রতিদান পাওয়ার বেলায় হাত শূন্য থেকে গেল। বয়স ও একাকীত্বের ভারে নানা অসুখ বাসা বেঁধে চলেছে একের পর এক। রটি,কাপড়া,মকানের লড়াই এ নিঃশেষ হয়ে গেলেন দাদিরা। মাথার উপরের ছাদটাও অধরা রয়ে গেল। সামাজিক নানা অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে দাদিরা। এবারের লকডাউন সম্মানটুকু কেড়ে নিল। বেরিয়ে পড়ল অভাবের ক্ষত। অভাবের সঙ্গে সম্মানের নয়, অধিকারের সম্পর্ক। এটকু নিশ্চিত করার কেউ নেই দাদিদের সামনে। সৎভাবে বাঁচার ইচ্ছাটাই আত্মসম্মান। আর সেই পথে দাদিরা প্রথম শ্রেণির নাগরিক। আত্মসুখ বিসর্জন দিয়ে জীবনের বেঁধে দেওয়া নিয়মের সামনে এভাবে আত্মসমর্পণ করতে ক'জন পারে! তবু এই ঠাকুরমাদের ঝুলি থেকে গল্প নয়, শুধু কান্না বেরিয়ে আসে। জীবনের সব বিচ্ছিন্নতাকে সাদরে স্বীকার করেছেন দাদিরা। অভিযোগ করেননি কোথাও। শুধু লকডাউনের দিনগুলো গলায় মাছের কাঁটার মত আটকে থাকল।

দস্তামারা,জঙ্গীপুর,মুর্শিদাবাদ।







কাথাষ্টিচ শিল্পী সোনালির লকডাউনের দিন

  কাঁথাষ্টিচ শিল্পী সোনালির লকডাউন যাপন    মেয়েদের সুন্দর মুখের নয়, সুন্দর কাজের জয়  সর্বত্র। সাফল্যের সীমানা দিগন্তপার। তাইতো সোনালীদের এত ...