Tuesday, 12 May 2020

রেফুল রুপেন,পানফুল দাদির তালাবন্দি জীবন

 দাদিদের লকডাউন যাপন
  
এই লকডাউনে সেহেরি আর ইফতারের মাঝের দৈনন্দিন জীবনটুকু গায়েব হয়ে গেছে তিন দাদির। শ্যুটার চন্দ্র আর প্রকাশ তোমর দাদিদের মত রেফুল,পানফুল, রুপেন দাদিরা মাথা তুলতে পারেনি। ওদের নিয়ে তাই 'ষান্ড কি আঁখ' এর মত সিনেমাও তৈরি হবে না। গল্প লেখাও হবে না। শাহিনবাগের দাদিদের মতও ঘর ছেড়ে রাস্তায় প্রতিবাদে শামিল হওয়া হয়নি রেফুল দাদিদের। এই দাদিরা গ্রামের এক এক প্রান্তে পড়ে থেকে অস্তিত্বের লড়াই লড়ছেন। কাজে বিড়িশ্রমিক। পরিচয়ে দাদি। প্রায় দুই যুগ ধরে স্বামীর ভিটা আগলে। ছেলেরা নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। বাপের ভিটাতেই আলাদা হয়ে থাকতে হচ্ছে মাকে। লকডাউনেও মায়ের মুখে একটুকরো রুটি তুলে দেয়নি ছেলেরা। মাও নাছোড়। ভিটাতেই ত্রিপল টাঙিয়ে পড়ে রয়েছে এক কোনায়। বিধবা ভাতার কথা শুনে হাসিই থামে না কানফুল দাদির। বলে "দুইবার না তিনবার ভাতা পেয়েছিনু কিসের জানিনা! ২৫ বচ্ছরের বিধবা আমি। পায়সা আছে এত সরকারের হামারঘে পুষার।"

রেফুল দাদির স্বামী দুই বছরের বাচ্চা রেখে মারা গেছেন। দীর্ঘ পঁচিশ বছর দাদি একাই সামলেছে সব। ছেলে বিয়ে করে মায়ের হাড়ি ভিন্ন করে দিল। মাটি কামড়ে ভিটাতেই পড়ে রইল দাদি। লকডাউনের দুর্দিনে ইফতারে মাকে ভিজা ভাত খেতে দেখেও ছেলে ছুটে আসে না একটিবার। তারপরে ছেলেকে বাপের ভিটা ছেড়ে দিয়ে মায়ের ভিটাতে আশ্রয় নিল রেফুল দাদি। দাদি বলে,"বিড়ি ইচ্ছা হলে বাঁধি,চোখে দ্যাখতে পাই না। বাদ চলে যায় বিড়ি। পায়সা কেটে নেয় মুন্সির লোক।" চোখে জল নিয়ে দাদি বলে " ভালো-মন্দ খ্যাতে দেয় না কেহু। তাতে কি জান আটকাবে? চেহে -চিন্তে চলছে। পায়সা নাই ওষুধের, জল -পানি মিলে না সবসময় তাও গরীবের ধক বেশি।"



কানফুলের স্বামী নাই কুড়ি বছর। বিড়ি বেঁধে যে ছেলেকে মানুষ করা সেই ছেলে ভিন্ন করে দিল মাকে। সুগার, প্রেসার নানা অসুখে জেরবার পানফুল দাদি। ছেলে হাঁড়ি আলাদা করতে বললে মানে লাগে কানফুলের। অভিমানে বিড়ির কুলায় বসে বিড়ি বাঁধতে বাঁধতে ঘুমিয়ে পড়ে। কতটুকুই বা খেতে পারে সে! বলে, "সারাজীবন একা থাকলাম ছেলে বুকে করে। কিন্তু সেই ছেলেই ছুঁড়ে ফেলে দিল। আজ এই বিপদেও পাশে কেউ থাকল না।" কানফুল দাদি বলে, "তাই বলে কি হাত গুটিয়ে লুকিয়ে যাবো? লকডাউনেই বাড়ী বাড়ী ঘুরে কিছু না কিছু পেটের জোগাড় করে আনি প্রতিদিন।"



রুপেন দাদির স্বামী তিন বছরের ছেলে রেখে মারা গেল। প্রায় ২৪ বছর ধরে একা হাতে ছেলেকে মানুষ করলেন দাদি। বিড়ি বেঁধেই সংসারের হেঁশেল বাঁচল। বিয়ে করে ছেলে ভিন্ন করে দিল মাকে। এতদিনের সংগ্রাম এক নিমেষে মিশে গেল মাটির সঙ্গে। তীরে এসে তরি ডুবে গেল রুপেনের। সুখের দিন দেখার কথা ছিল। ছেলে বড় হয়ে মাকেই দেখবে এটাই তো প্রকৃতির নিয়ম। হল না।



এই দাদিরা অত্যন্ত কম বয়সে মা হয়েছেন। দাদি হয়ে পরের প্রজন্ম তাদের ছুঁড়ে ফেলার বাইরে কিছুই করল না। দাদিরা জীবনের সব ধর্ম পালন করেলেন বীনা প্রশ্নে। শুধু প্রতিদান পাওয়ার বেলায় হাত শূন্য থেকে গেল। বয়স ও একাকীত্বের ভারে নানা অসুখ বাসা বেঁধে চলেছে একের পর এক। রটি,কাপড়া,মকানের লড়াই এ নিঃশেষ হয়ে গেলেন দাদিরা। মাথার উপরের ছাদটাও অধরা রয়ে গেল। সামাজিক নানা অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে দাদিরা। এবারের লকডাউন সম্মানটুকু কেড়ে নিল। বেরিয়ে পড়ল অভাবের ক্ষত। অভাবের সঙ্গে সম্মানের নয়, অধিকারের সম্পর্ক। এটকু নিশ্চিত করার কেউ নেই দাদিদের সামনে। সৎভাবে বাঁচার ইচ্ছাটাই আত্মসম্মান। আর সেই পথে দাদিরা প্রথম শ্রেণির নাগরিক। আত্মসুখ বিসর্জন দিয়ে জীবনের বেঁধে দেওয়া নিয়মের সামনে এভাবে আত্মসমর্পণ করতে ক'জন পারে! তবু এই ঠাকুরমাদের ঝুলি থেকে গল্প নয়, শুধু কান্না বেরিয়ে আসে। জীবনের সব বিচ্ছিন্নতাকে সাদরে স্বীকার করেছেন দাদিরা। অভিযোগ করেননি কোথাও। শুধু লকডাউনের দিনগুলো গলায় মাছের কাঁটার মত আটকে থাকল।

দস্তামারা,জঙ্গীপুর,মুর্শিদাবাদ।







No comments:

Post a Comment

কাথাষ্টিচ শিল্পী সোনালির লকডাউনের দিন

  কাঁথাষ্টিচ শিল্পী সোনালির লকডাউন যাপন    মেয়েদের সুন্দর মুখের নয়, সুন্দর কাজের জয়  সর্বত্র। সাফল্যের সীমানা দিগন্তপার। তাইতো সোনালীদের এত ...