Sunday 31 May 2020

অভিবাসী শ্রমিক রিম্পার তালাবন্দি জীবন

রিম্পার লকডাউন যাপন

অভিবাসী শ্রমিক রিম্পা লুধিয়ানা থেকে গ্রামে ফিরে বাচ্চাদের কাছে পৌঁছাতে পারল না। ১৪ দিনের  হোম কোয়ারান্টাইন। ইদেও বাচ্চাদের একটিবার ছুঁয়েও দেখা হল না। বছরের শুরুতে  গিয়েছিল কাজে পাঞ্জাবে। কারখানায় প্যাকেটিং এর কাজ করত। সংসারের অভাব দূর করতে নিজের দুই বাচ্চাকে মায়ের হাতে তুলে দিয়ে পাড়ি দিয়েছিল পাঞ্জাব। মাত্র নয় ও দশ বছরের বাচ্চা দুটোকে গ্রামেই ফেলে যেতে
হয়েছিল পয়সার খোঁজে।


নবম শ্রেনি পাশ রিম্পার বিয়ে হয়ে যায় কম বয়সে। রিম্পার আব্বা দিনমজুর। মেয়ের পড়াশুনা টানার চেয়ে সংসারে থালা কমানো জরুরি ছিল। রিম্পাকে তাই নিজের বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে হয় বিয়ে করে। কিন্তু অভাব পিছু ছাড়ে না। স্বামীর ঘর করতে গিয়েও সেই অভাবের সঙ্গে লড়াই জারি থাকে। ছেলেরা একটু বড় হতেই রিম্পা বুঝে যায় এভাবে চলবে না। কিছু একটা উপায় বের করতেই হবে। গ্রামে পয়সা উপার্জনের কোনোও রাস্তা সে খুঁজে পায়না। অবশেষে বিদেশে শ্রমিকের কাজে যোগদানের কথা ভাবে। গ্রামের অনান্য অভিবাসী শ্রমিকদের সঙ্গে দল বাঁধে।

লুধিয়ানায়  দুই হাজার টাকা দিয়ে  ঘর ভাড়া নেয়৷ লকডাউনের সময় ফিরতে চাইলে পুরো বাড়ি ভাড়া মিটিয়ে দিতে বলে মালিক। রিম্পাদের কাছে টাকা না থাকায় তাদের ঘরটাও রেখে আসতে হয়েছে। এখন এদের অবস্থা জলে কুমির ডাঙায় বাঘ এর মত। গ্রামে কাজ নেই। যেখানে কাজ সেখানে ফেরার কি উপায় জানা নেই। ফেরার পর কাজটা ফিরে পাবে কিনা জানেনা।

মাত্র ২০০ টাকার মজুরীতে কাজ করে রিম্পা। ২০২০ সালের এপ্রিল মাস থেকে অদক্ষ শ্রমিকের ন্যূনতম  মজুরীর  স্ল্যাব অনুযায়ী শিল্প শ্রমিক পাবে ৫২৩টাকা - ৪৩৭টাকা -৩৫০  টাকা।  কিন্তু বাধ্যতামূলক  ন্যাশন্যাল ওয়েজ ফ্লোরের পথ না ধরায় আঞ্চলিক বৈষম্য থেকে গেছে। রিম্পারা তারই শিকার। অন্যদিকে মজুরীরতে লিঙ্গ বৈষম্যের দিক তো প্রবল ভাবে আছে। যে কাজে রিম্পা দুশো টাকা সেই কাজেই একজন পুরুষ পাচ্ছে  তিনশো থেকে সাড়ে তিনশো টাকা। রিম্পার স্বামীও দিনমজুর। তার কাজের দিনে  আয় হয় পাঁচশো। আসলে ন্যূনতম মজুরী নির্ধারণের জন্য আই এল ও থেকে  পাওয়া গাইডলাইন মানা হয় না। কর্মাচারী ও উদ্যোগপতিদের মধ্যে বৈধ প্রয়োজনের ভিত্তিতেই সমতা আনা সম্ভব। সেই নিরিখে কালেক্টিভ বারগেইনিং বা সামাজিক কথোপকথন হয় না বললেই চলে। উদ্যোগপতিদের সুবিধা বেশি করে দেখা হয়।

2018 এর আই এল ও এর  প্রতিবেদনে ভারত এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ২২ টি দেশের মধ্যে বেতন সন্তুষ্টিতে তলার দিক  থেকে চতুর্থ স্থানে রয়েছে ভারত। বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং মঙ্গোলিয়ার উপরে।

লকডাউনের সময় মজুরি পাওয়ার ক্ষেত্রে রিম্পাদের বাড়তি সুবিধা নেই। আগাম টাকা দিয়ে দেওয়ার প্রস্তাবও নেই। এই পরিস্থিতিতে নিজেদের ও পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যে কাজের দরকার সেটাও হাতে নেই। অভাবে দুচোখ অন্ধকার দেখা ছাড়া আর হাহাকার করা ছাড়া রিম্পাদের কিচ্ছু করার নেই।

গোবড়গাড়া,হরিহরপাড়া,মুর্শিদাবাদ

Saturday 30 May 2020

কারখানা শ্রমিক নূরের তালাবন্দির দিন

নূর খাতুনের লকডাউন যাপন

"কাজ ঢুড়ে পাইনিখো! তাই ঘর ছেড়ে ম্যাশিনের কাজে বিদ্যাশ যাওয়া।" কারখানার কাজে নিযুক্ত নূর খাতুন একদম পেটের দায়ে পাঞ্জাব পাড়ি দিয়েছিলেন। প্রায় নয় বছর ধরে কাজ করছেন। লকডাউনে নানা ঝামেলা অতিক্রম করে ঘরে ফিরেছেন। সমস্যা হল নূর নিজের বয়সটাও সঠিক জানেন না। আবার সাবলীল ভাবে বলে, "কিছুই বুঝতুক না তখন বিহা। বাপ কে কাজ করতে য্যাতে দেখিনি। ভাইরা মাঠে ঘাটে খাটতক। ওয়্যাই লেগে স্কুলে যায়নি। পড়ায়নিখো।"

উনি আসলে একজন শ্রমিক সেটাও বোঝেন না সেভাবে। তাই শ্রমিকের অধিকার নিয়ে তার কিছুই জানা নেই। সকাল আটটায় দু হাজার টাকার ভাড়া ঘর থেকে ফ্যাক্টরি যেতেন । ফিরে আসেন রাত আটটায়। এত ঘন্টা ধরে মেশিনে মাল তুলতে সহায়তা করে তারপর প্যাকেটিং এর কাজ করতেন। রবিবারেও কাজ চলে। "শুধু কাজে ঢিল পড়লে ছুটি"। নূর বলে, "দুইডা টেশিন। একডা সামনে। একডা পিছনে। একডাতে নাট বল্টু চড়াতু। তারপর আর এক জাগায় এর এক টেশিনে ট্রেসিং করতু। তাপর গনতি করতু। তারপর প্যাকেট বানাতু।" একদিনে তিন জায়গায় কাজের নামে তাকে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়ানো হয় নূরকে। মাত্র দুশো টাকার বিনিময়ে। এভাবেই নাট বল্টু তৈরির সহায়ক হিসেবে কাজ করেন লুধিয়ানায় এক যন্ত্রাংশ নির্মাণের কোম্পানীতে । নূর এটাকেই কাজ করা বলে জানে। সেই কাজ সে সংসারের জন্য করছে। কারণ সে গরিব। তিন ছেলে মেয়ে নিয়ে স্বামীর একার উপার্জন যথেষ্ট নয়। তাই তার কাজ করাকে সে নিয়তি বলেই মেনে এসেছে। স্বামীও পাঞ্জাবে তামা -লোহা কাটার কাজ করে।


নূর বাড়ি ফিরে এসে পড়েছে বিপদে। লকডাউনেরর জন্য টাকা পায়নি। স্বামীর কাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। জমানো টাকা খেয়ে দীর্ঘ দেড় মাস লড়াই এর পর ফিরে এসেছে ইদের আগে গ্রামে। ছেলে মেয়েদের নতুন জামা দূরে থাক খাবারও কিছু কিনতে পারেনি। নিজে একটা নতুন শাড়িও পরতে পারেনি ইদের নামাজের দিন।

লকডাউনে তড়িঘড়ি পালিয়ে এসেছে দেশে। এখনোও পাঞ্জাবে ঘরে সব তালাবন্দি। কখন ফিরতে পারবে জানেনা। ফিরে কাজ থাকবে কিনা তাও জানেনা। এদিকে ঘর ভাড়ার টাকা তো গুনতে হবে ভেবেই মাথায় হাত নূরের। মহিলা শ্রমিকের আলাদা স্বীকৃতি নেই। সামান্য টাকায় নানারকম কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকতে হয় তাকে। পারিশ্রমিক সামান্য। প্রতিদিন শ্রম চুরি। কিন্তু নূর কাজ করে খায় এতে খুব খুশি। "ব্যাটাছেলের সঙ্গে কথা কহিতে দেয় না। ম্যায়াদের সঙ্গে ম্যায়ারা একসঙ্গে কাজ করত। নিজের নিজের পায়সা নিয়ে বাড়ি আসতু। কাজে ভালো লাগত।"

এই হাড় ভাঙা বেহিসেবী কাজে নূরদের কোনোও অভিযোগ নেই। শেষ কথা "সাহাব খুব ভালো। ব্যাটাছেলেদের আলাদা আর মেয়্যাছেলেদের আলাদা ঘর কাজের।" এদের কাছে ভালো হতে গেলে বিশেষ কোনোও গুনের দরকার হয়না। এতটা সরল মহিলাদের শ্রমিক হিসেবে বছরের পর বছর অতিরিক্ত খাটিয়ে কোম্পানী মুনাফা করতে থাকে। কিন্তু বিপদে একমাসের মাইনে আগাম দিয়ে বাড়ি পাঠানোর দায় মাথায় নেয় না।
রুকুনপুর,হরিহরপাড়া, মুর্শিদাবাদ

রেনুকা খানমের লকডাউনের দিন

 রেনুকার লকডাউনের দিন

 গ্রুপের নাম ভরসা হলেও রেনুকা ৪৫ টি পরিবারের ভরসা হয়ে উঠতে পারল না। দীর্ঘ লকডাউন কোমর ভেঙ্গে  দিল রেনুকার। ঘরভর্তি জুটের ম্যাট,তারের ব্যাগ  ও দেওয়াল সজ্জার  জিনিষ নিয়ে হস্তশিল্পী রেনুকা  একেবারে অসহায়। মেলা বাতিল। বিক্রী বন্ধ। প্রতি বছর দমদম,বারাসত থেকে অর্ডার আসে ম্যাটের। তারপর বাসে করে প্রোডাক্ট দিয়ে পাঠায় রেনুকা। এবারে সেটাও হয়নি। রেনুকার নিজের দলের বারোজন মেয়ের বাইরে আছে প্রায় তেত্রিশ জন। সকলেই হাত গুটিয়ে বসে আছে।  এদের অনেকের পরিবারে নিজেদের উপার্জন ছাড়া অন্য কোনও আর্থিক সংস্থান নেই। রেনুকার পরিবারে স্বামীর উপার্জন  লকডাউনের পর চালু হওয়ায় কোনওভাবে সংসার চলছে। কিন্তু নিজের সঙ্গে জুড়ে থাকা মেয়েদের সাহস জোগাতে পারছেনা রেনুকা।লকডাউনের অর্তকিতে হানা। বানানো জিনিষের চাহিদা নেই। এদিকে মেয়েদের কাজ বন্ধ থাকায় হতাশা ও কষ্ট বেড়েই চলেছে।



 মূল সমস্যা হচ্ছে রেনুকাদের মেইনস্ট্রিম মার্কেটের সঙ্গে যোগাযোগ খুব বেশি গড়ে উঠছে না। লার্জ স্কেল এন্টারপ্রাইজ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রেও বেশি দূর এগিয়ে নেই ওরা।যদিও ভারতে পঞ্চাশ মিলিয়ন মহিলারা সেল্ফ হেল্প মুভমেন্টের অংশীদার।রেনুকারা আর্টিজান কিন্তু ফ্যাশন ডিজাইনার ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে এরা গাঁটছড়া বাঁধতে পারেনি।

মেলার অপেক্ষায় দিন কাটে। তার মূল কারণ এরা কেউ টেকনোলজি ফ্রেন্ডলি নয়। ইনফরমেশন ও নেই এদের কাছে। নিজের কাজ বিশ্বের দরবারে বাইরের উদ্যোগ ও সাহায্য ছাড়া কিছুতেই নিয়ে যাওয়ার সাধ্য নেই। বিপদের সময় মানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বিপর্যয়ে  এরা পুরোপুরি বিধ্বস্ত। নিজের দলকে বা মেয়েদের বাঁচানোর সাধ্য প্রায় নেই বললেই চলে! গ্রুপ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছে। তবুও আশায় দিন গুনছে রেনুকা।



Friday 29 May 2020

গোলাপির তালাবন্দির দিন


গোলাপির লকডাউন যাপন

বাচ্চা বায়না ধরেছে দোকান যাবে।  গ্রামের ভেতরের দোকান খোলা। কিন্তু গোলাপির সাহস নেই। তিন ছেলে -মেয়ের হাত ধরে নিয়ে দোকানের দিকে  যাওয়ার। কি কি  খেতে চাইবে বাচ্চারা কেজানে! এদিকে হাতে মাত্র কুড়ি টাকা আছে গোলাপির।  তাও মা  এসে বাচ্চাদের কিছু কিনে খাওয়ার জন্য দিয়ে গিয়েছিল। গোলাপি  টাকা কোথায় পাবে? স্বামী তো বাড়িতে বসে পাক্কা দুই মাস। সংসার তো বাপের বাড়ির লোকই টেনে দিচ্ছে। কিন্তু কতদিন!


গোলাপি স্কুলে যায়নি। সময়ের আগেই বিয়ে।  তিনটে বাচ্চা নিয়ে পাখির বাসার মত দেখতে ঘরে বাস। ডাল -পাতা-কঞ্চি দিয়ে তৈরি গোলাপির ঘর। আবাস যোজনা ও সরকারি প্রকল্প  মাথা হেঁট করবে। আশ্চর্য হয়ে মানুষ প্রশ্ন করবে গোলাপী  এখনো বাড়ি পায়নি কেন? যদিও এটাই গোলাপীর তাজমহল। বিয়ে হয়ে গেছে মানেই শাহজাহান পেয়ে গেছে।  জীবনের বড় পরীক্ষায় পাশ করে গেছে। লকডাউন না এলে  গোলাপি জানতই না যে তিন ছেলে -মেয়ের জন্য প্রতিদিন ভাত জোগাড় করা এত বড় চ্যালেঞ্জ। স্বামীর রোজগার শূন্য। হাতে নগদ পয়সা নেই।

"খ্যাতে দিলে ভালো হয়। ঘর যদি দেয় তো খুবই ভালো হয়" নিষ্পাপ মন নিয়ে বলে গোলাপি। স্বামী পাইপের কাজ করে। কখনো অদক্ষ শ্রমিকের কাজ করে। কাজে গেলে টাকা আনে।  নইলে বাড়িতে বসে। যে টাকা আনে  তা ফুরালে আবার কাজে যায়। লকডাউনে চাল আটা যা পেয়েছে তাতেই চলছে। লকড়ির অভাব। তাই দুইবেলা ভাতের চাল ফুটানো  কঠিন। পেঁপে,শাক, ডাঁটা জোগাড় করে দিন চললেও নগদ পয়সা হাতে না থাকায় চায়ে চিনি দেওয়া মুশকিল।

বাচ্চা আবার স্কুলে যায়। দ্বিতীয় শ্রেণি। কতদিন যাবে গোলাপি জানেনা। বাপের হাত ধরে কাজেও নামতে হতে পারে! গোলাপি বলে, "আমি তো স্কুলে যাইনি তাতে কি হয়েছে? আমি কি করতে পারি না?" একদম তাই। গোলাপীদের ছেলেমেয়েদের কাছে পড়াশুনা এক রকম বিলাসিতা। এটা না শিখেও মানুষ বাঁচে এ তাদের  স্থির বিশ্বাস। পড়াশুনা নামক  বিলাসিতা দূর করার জন্য গোলাপির ছেলেদের হাত ধরার কেউ নেই। দিন বদলেছে। মানুষ অসাধ্য সাধন করেছে । কিন্তু প্রদীপের তলায় অন্ধকারের মত আড়াল থেকে গেছে গোলাপিদের জীবনে সুদিন ফেরার গল্প। লকডাউন তো গোলাপিদের জীবনটাকেই আলেয়ার মত ছুটিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে।  এত বড় বিপদের সামনে বুক চিতিয়ে  দাঁড়িয়ে তাদেরও পাল্টা চ্যালেঞ্জ "রোগে মরতাম ব্যাপার না৷ কিন্তু এমনি করে ভিক্ষা করাবে ক্ষ্যামতা থাকতে? আমাদের তো জাত গেল।"
শেখপাড়া, কুলগাছি,ভগবানগোলা ১

Thursday 28 May 2020

বিড়ি শ্রমিক সোনামনির তালানবন্দির দিন

সোনামনির লকডাউন যাপন

"লকডাউনে ঘরে তো আমরা বেকার। সরকার থেকে চাল দিয়েছে। নগদ পাঁচশো টাকাও দিয়েছে ব্যাংকের খাতায়। কিন্তু সে টাকায় তো একদিন মাংসও খাওয়া হবে না। সারা মাস তরকারি,মাছ খাওয়া হবে কি করে? ঘরে রাখা বাড়তি চাল যদি আজ বেঁচে দিই তো কদিন ডাল -তরকারি হবে?" প্রশ্ন বিড়ি শ্রমিক সোনামনি সাহার। প্রায় দশ বছরের বেশি বিড়ি বাঁধছে সোনামনি। নেই কোনও কার্ড। নেই শ্রমিকের স্বীকৃতি।

পড়াশোনা নাকি গরীব মেয়েদের জন্য নয়। তাড়াতাড়ি মেয়ের বিয়ে দিয়ে মাথার বোঝা না নামলে মুশকিল। এটাই বিশ্বাস সোনামনির। সে বেজায় খুশি যে লকডাউনের আগেই তার পরিবারের সদস্য সংখ্যা দুই জন কমেছে। দুই মেয়ের বিয়ে না হয়ে গেলে বড় ও ভারি সংসারের চাকা বন্ধ হয়ে যেত লকডাউনে! দেড় মাসের বেশি সোনামনি বিড়ি বাঁধেনি লকডাউনের জন্য। এখন বিড়ি বাঁধার সূযোগ  এলেও শরীর ঠিক চলছে না। তাই বিড়ির পাতা নেয়নি। সোনামনি সাহার বিয়ে পনেরো বছর বয়সে। তারপর  সংসারের ভার মাথায় এসে পড়ে। পরিবার  বেকার স্বামীর হাতে সোনামনিকে তুলে দিয়ে দায় সারে। নিজের বিড়ি বাঁধার বাইরে বাপের বাড়ি থেকেও সাহায্য আসতে থাকে। কিন্তু এভাবে হাত পেতে কতদিন? তাই  অবশেষে স্বামী কে সাকার করার দায় সোনামনি মাথায় তুলে নেয়। নিজের বিড়ি বাঁধা থেকে জমানো টাকা ও বাবার সাহায্য নিয়ে স্বামীকে কিনে দেয় ভ্যান। দুই মেয়ে ও এক ছেলে মানুষ করে এভাবেই।


নিজে টাকা উপার্জন করলেও সোনামনির লকডাউনে বড় চ্যালেঞ্জ স্বামীর ঘরে বসে যাওয়া। বছর পাঁচেক আগে সোনামনির বাবা বেকার জামাইকে ভ্যান কিনতে সাহায্য করে। তারপর সেটা থেকে ভালো আয় না হওয়ায় আবার কিছুদিন আগে টুকটুক কিনতে সাহায্য করে। তারপরেই লকডাউনে ঘরে বসে যায় স্বামী। এতদিন সংসারের জন্য হাজার, দেড় হাজার  বিড়ি বেঁধে এসেছে সোনামনি। এখন শরীর সঙ্গ ছেড়েছে। তিনশো বিড়ি বাঁধতেই হাঁপিয়ে উঠছে। তবু লকডাউনে  উপার্জন মার যাওয়ায় মন খারাপ সোনামনির।

 নিজের বাবার দৌলতে একটা গ্যাসের সিলিন্ডার ঘরে আনতে পেরেছে সোনামনি কিন্তু রান্না সেই বাড়ির আখাতেই হয়। লকড়ি জোগাড় করে করতে হয়। বাড়িতে স্বামী ও ছেলের ভার তার মাথার উপরেই। সংসার এভাবেই চলেছে। লকডাউনেও নিজের বাপের বাড়ির সাহায্য নিয়ে চলেছে সোনামনি। ঘরে চাল আছে। কিন্তু তার বাইরের ব্যবস্থা করার জন্য কেউ এগিয়ে আসে নি। তবে ঝড়ের গতি তেমন আকার না নেওয়ায় মাথার উপরে  টালি বেঁচে আছে। আশ্রয়হীনতা থেকে রেহাই পেয়েছে সোনামনি।

সোনামনি নিজের অন্দরমহলের কাঁটাছেড়া বেশি না করে একটিই কথা বলে,"গরীবের  কী দাম আছে! অভাবের সংসারে লকডাউন, বৃষ্টি- ঝড়ের দাপট চললে মরে যাওয়ার কথা কিন্তু তা তো হয় না। প্রতিবার টাল ভাঙা পড়ে, প্রতিবার আবার মাথার ছাদের মেরামতি চলে! প্রতিবার বৃষ্টিতে ত্রিপল ছেঁড়ে, প্র‍তিবার কিনতে হয়।" সোনামনি বলে, "দুই মাস একটা মানুষ  টুকটুক না চালিয়ে ঘরে বসে থাকলে সে ঘর কেমন থাকবে! বেঁচে আছি। কিন্তু মানুষের অধিকার  কেউ দ্যায় না।" লকডাউনে চাল,আটা পেলাম। কিন্তু দুই মাস আট দিন কি তাতে চলে!
সাহাপাড়া,লালখানদিয়ার ,মুর্শিদাবাদ

পূর্ণিমার লকডাউনের দিন

পূর্ণিমার লকডাউনের দিন

ছোলা কিনে ছাতু তৈরির ব্যবসা পূর্নিমার। বিয়ের পর থেকেই এই ব্যবসা শুরু। স্বামী চোখে ভালো দেখে না। তাই ঘরে বসেই চলে এই ব্যবসা। লকডাউন বাধ সেধেছে রোজগারে। বাজারে ছোলা কেনা যায়নি। তাই তা এনে ভেজে ও পিষে প্যাকেট করে বিক্রীর কাজও বন্ধ।  মাসে ৩০-৩৫ কেজি ছাতু বিক্রী হয় পুর্ণিমার। ৫০/১০০/২০০/৫০০ সবরকম দামের প্যাকেট তৈরি করে। লকডাউনে কাজ আটকে পড়ে আছে। বছর পঁয়ত্রিশের পূর্ণিমা একেবারে নাজেহাল। 

ছাতু বিক্রী করে  লাভ থাকে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। ছেলের ছয় বছর। নিজের অভাবের পরিবার ।তাই পূর্ণিমার লেখাপড়া শেখা হয়নি। সময়ের আগেই বিয়ে। সেখানেও খুব বেশী স্বচ্ছলতা নেই। স্বামীর নিজেস্ব ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। শারীরিক অসুস্থতার জন্য। পুর্ণিমাকে সংসারের দায় কাঁধে তুলে নিতে হয়। পরিবারে সময় দিয়ে উপার্জনের কথা ভেবেই ছাতু বিক্রীর কথা মাথায় আসে। সাহস করে ব্যবসা শুরু করে পূর্ণিমা। তারপর এই লকডাউনের যন্ত্রণা। টানা দুই মাস পর কাজ শুরু হলেও বিক্রী কমে যায়। ঘরের বাইরে লোক কম বেরোতে থাকে। প্যাকেটস্থ ছাতু বাড়িতেই পড়ে আছে উদ্বৃত্ত।


 

পূর্ণিমা অপেক্ষা করছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার। সংসার চালানো খুবই কঠিন। জমানো কিছু টাকা খরচ হয়ে যাওয়ায় আশংকা আগামীতে কী হবে? ছেলে নিয়ে একদম কঠিন লড়াই এর  দিন কাটছে পূর্ণিমার।

গোকর্ণ,মুর্শিদাবাদ   


Wednesday 27 May 2020

বাসন্তির লকডাউনের দিন

বাসন্তির লকডাউন যাপন

বাসন্তি  বড় আশা নিয়ে গিয়েছিলেন স্বামীর হাত ধরে নয়ডা। প্রায়  চার বছর আগে পাড়ি দিয়েছিলেন কাজের সন্ধানে। গতবছরেই  এসেছিলেন নিজের দেশে। সপরিবারে। তখন কল্পনাও করেনি যে বিপর্যয় এভাবে নেমে আসবে। স্বামী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে মাস পাঁচেক আগে। সামান্য পায়ে ব্যাথা বড় অসুখের আকার নেয়। তারপরে আসে লকডাউনের খাড়া। বাসন্তি ঠাকুর নিজেও ঘরে বসে থাকতে চায়নি। কিছু করার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু ছোটো বাচ্চা রেখে কাজে যাওয়া সম্ভব হয়নি।

স্বামী নয়ডায় সার্কিট কোম্পানীতে কাজ করে। নানা জায়গায় চিকিৎসা করেও স্বামীকে সুস্থ করে তুলতে পারে না বাসন্তী। স্বামী শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে। কোম্পানী যেখানে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে সেখানে উন্নতি না দেখে বাসন্তী নিজেই টাকা দিয়ে ব্যবস্থা করে স্বামীর চিকিৎসার। এইমস এ চিকিৎসা চলে বেশ কিছুদিন। লকডাউনে তা বন্ধ হয়ে যায়। ফরিদাবাদে স্বামীকে নিয়ে যায় এক পরিচিত দিদি। সেখানে স্বামী আটকে পড়ে। এদিকে ছোটো বাচ্চা নিয়ে মহা  বিপদে পড়ে লকডাউনে  বাসন্তী।



বাসন্তী  অকপটে বলে  সংসার  চলে যেত। মেয়ে প্রাইভেট এক স্কুলেও পড়ত। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে আজ এই জায়গায় এসে পড়েছে। নিজের জমানো সব টাকাই স্বামীর অসুখে খরচ করে ফেলেছে। দৈনন্দিন খাবারের জন্য বাইরে পাওয়া রেশনের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। স্বামীর অসুখ ও লকডাউনের সময় খরচ দুটি চালাতে অস্থির বাসন্তী। কোম্পানী কাজে  আদৌ  বহাল রাখবে কী না নিশ্চিত নয় বাসন্তী। স্বামীর  ফিটনেস সার্টিফিকেট জোগাড় হবে কিনা তা নিয়েও নিশ্চিত নয় বাসন্তী। আবার ফিরে এসে নতুন কাজ পাওয়াও অনিশ্চিত। সবমিলিয়ে এক পরিবার নিয়ে বিরাট সংকটে। বাচ্চা সবেমাত্র দ্বিতীয় শ্রেণি।

বাসন্তী বলে, "অনেক স্বচ্ছল পরিবারেও বিভিন্ন রকমের সমস্যা দেখা দিয়েছে। বাচ্চার খাবার  ষ্টক করা যায়নি। সেটা সংগ্রহ করাও খুব কঠিন হয়ে পড়েছে। কাছের দোকান ১,২ সিরিজ ধরে খুলছে। সেখানেও খুব  ভিড়।" বাসন্তীর আক্ষেপ,
লকডাউন এত অতর্কিতে আর এতদিন দীর্ঘস্থায়ী  না হলে স্বামী হয়ত ফিটনেস সার্টিফিকেট জোগাড় করে কাজে যোগ দিতে পারত। একটা পরিবার অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি পেত। এখন স্বামী ফিরবে ফরিদাবাদ থেকে ৯ ই জুন। তারপরে কাজের কি হবে কেউ জানেনা। অল্প সংখ্যক লোক নিয়ে ফ্যাক্টরি চালু হয়েছে। বাসন্তী জানেনা তার স্বামীর ডাক আদৌ পড়বে কিনা। এদিকে সংসারের সবটাই বাসন্তীর হাতের মুঠো থেকে একটু একটু করে বেরিয়ে পড়ছে।  লজডাউন উঠলে স্বামীর ফিরে আসার অপেক্ষায় মুহূর্ত  গুনছে বাসন্তী।

কালনা,পূর্ববর্ধমান।

Tuesday 26 May 2020

জোহরার তালাবন্দির জীবন

জোহরার লকডাউন যাপন 

"কেহু খ্যাতে দিলে খাই। না হয়ত না খ্যায়ে পড়ে থাকি দুইঝনা।" লকডাউনের দিন এভাবেই কেটেছে জোহরার। তবুও জোহরা খুব জোর বেঁচে গেছে। আমপানে বাড়িটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ার কথা। সারা রাত জেগেই কেটেছে জোহরার। সকালে বাড়িটা খাড়া দেখে জোহরা নিজেই অবাক। এই মাটির বাড়িতেই জীবন কেটে গেছে। জানেই না প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার কথা। পাকা বাড়ির স্বপ্ন কোনও দিন তাই মনেই আসেনি। লকডাউনে একদিন আখা জ্বলেছে তো দুই দিন বন্ধ। লকড়ি পাওয়া খুব সমস্যা। নেই ঘরে অন্য জ্বালানির ব্যবস্থা। তবু লকডাউন ও আমপানের দাপট মাথায় নিয়ে বেঁচে গেল জোহরা ও তার মাটির ঘর।

বাড়িতে ছাগল মুরগি পালন করে জোহরা। তা থেকেই আয় হয় জোহরার সংসারের। মুরগির ডিম বিক্রী করে নিয়মিত। সেই থেকে কিছু পয়সা পায়। তা দিয়েই মেটে তেল লবন কেনার খরচ। বাড়ির পোষা ছাগল বিক্রী করে আসে টাকা। সারাবছর এভাবেই চলে। স্বামী বহুদিন থেকেই কাজ করতে পারেনা। বার্ধ্যক্যজনিত অসুবিধে। ছেলে ভিন্ন হয়ে গেছে। মেয়েরা এসে মাঝে মাঝে রান্না করা খাবার দিয়ে যায়। ঘরে চাল আছে। তা সেদ্ধ করার উপায়ও হাতের কাছে নেই। যেদিন জোটে না সেদিন মুখ গুঁজে পড়ে থাকে। লকডাউনে বেচাকেনা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় খুব অসুবিধেয় পড়েছে জোহরা। জোহরা বলে, "সারাজীবন ডিম আর এটা -ওটা বেঁচে এমন করেই চালিয়েছি। ছেলেমেয়ে মানুষ করেছি। লকডাউন শুধু প্রতিদিনের আখাটা জ্বলতে দিল না।" আবাস যোজনায় অনেকের বাড়ির বরাত এসেছে এবারে। দেখা যাচ্ছে, যার বাড়ি আছে তার নামও আরেকবার চলে এসেছে। জোহরার বাড়ির চেহারা বলছে তিনি অন্যতম দাবিদার। কিন্তু তিনি জানেন না তার নাম আছে কিনা! দেখে দেওয়ার মত লোকও নেই তার। জোহরাদের মত যারা উজালা ও আবাস যোজনার আওতায় এলো না তাদের কি হবে? সারাজীবন পাতা-কাঠ জোগাড় করে দিয়ে রান্না করে যাবে? একটা পাকা বাড়ি ও সিলিন্ডারের স্বপ্ন নিয়ে জীবন কেটে যাবে? এদের জন্য ব্যবস্থা করা যাদের কথা ছিল তারা দুর্দিনে দুই কেজি চাল ও একটি তেলের বোতল দিয়ে বিশ্বাস অর্জন করে নিল। কিন্তু গনতান্ত্রিক অধিকার ও সরকারি ঘোষণা সুবিধে পাওয়ার জন্য যে সামর্থ্যটুকু প্রয়োজন সেটাই অর্জন করলো না। এদের সূযোগ পাওয়ার জন্য ফর্মটাও কেউ দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে এসে ভরে দিল না। গ্রাম স্বরাজের আদর্শের তলায় চাপা পড়ে থাকল জোহরাদের দীর্ঘশ্বাস। কুলগাছি,শেখপাড়া ,ভগবানগোলা ১

Sunday 24 May 2020

অভিবাসী শ্রমিক কাকলীর তালাবন্দির দিন

 কাকলীর লকাউন যাপন

বাড়ি ফিরতে অভিবাসী শ্রমিক কাকলীকে ধার করতে হয়েছে দশ হাজার টাকা। বাসে দিল্লি থেকে রায়গঞ্জ। মা ও ছেলের ভাড়া দশ হাজার টাকা। সেখান থেকে আরও তিনশো টাকা ভাড়া দিয়ে বহরমপুর ফেরা। কাকলি গৃহপরিচারিকার কাজে যায় দিল্লি। সেখানে নিজের চব্বিশ বছরের ছেলেকেও ডেকে নেয়। ছেলের মাত্র দুই দিন কাজ করার পরেই লকডাউনের ঘোষণা দেয়। এদিকে লকডাউনের জন্য শেষ মাসের কাকলীর  মাইনেও বাকি থেকে যায়। হাতে পর্যাপ্ত নগদ টাকা না থাকায় কাকলিকে পালিয়ে আসতে হয়। ওখানে থাকলে অনাহারে কাটাতে হবে। বাড়ি ফিরে এলে অন্তত আত্মীয় পরিজনের কাছে সাহায্য পাওয়া যাবে। সেই ভরসায় টাকা পয়সা ধার করে বাড়ী আসা। এখন হোম কোয়ারান্টাইনে আছে মা -ছেলে। ইদে একদম খালি হাত। ঘরে বন্দি। খাবার নেই। আত্মীয়রাও দেখা করতে আসতে পারছে না। খুব অসহায় হয়ে পড়েছে কাকলী। অভাবের তাড়নায় ঘর ছেড়েছিল। কিন্তু নতুন অভাবের ভার  নিয়ে ফিরল বাড়ি। খুশির ইদ বিষাদে ভরল। না মিলল বখশিস। না মিলল নতুন জামাকাপড়।  কাকলির আপশোস, "জোয়ান ছেলেটা ঘরে পড়ে রইল। ছেলেটার  তো ইদ ভালো করে পালনের কথা ছিল । কিন্তু এত টাকা ধার  করে এমন মন খারাপ যে আমাদের আর ওঠার ক্ষমতা নেই।"



এই দেশের দ্বিতীয় জনপ্রিয় পেশা এই পরিচারিকার কাজ। এদের ছুটি ও অসুস্থতা নিয়ে নেই আলাদা  কোনও ব্যবস্থা। সারাবছর জাঁতাকলে পিষ্ট। মাসের প্রথম দিনে মেলে না মাইনেও। সবটাই বাড়ির মালিকের উদারতা ও ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। অনলাইন এজেন্সি এখন কাজের মেয়ে খুঁজে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছে। জায়গাভেদে গৃহ কাজ ও বেবি সিটার অনলাইনের মাধ্যমেও বুক করা যায়। সিটি গুলিতে সারাদিনের মেইড নেয়  নয় হাজার থেকে  এগারো হাজার। দিনের অর্ধেক সময় কাজ করলে পায়  ছয় থেকে আট হাজার টাকা।  কিন্তু  কাকলীদের মত পরিচারিকাদের খুব কম টাকায় কাজ করতে হয়। বার বার কাজও ছাড়তে হয়। ছেলের অসুখ বা বাড়ির মেরামতির জন্য দুই দিন না গেলেই কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়।  আবার মালিকের মুখের উপর জবাব দিলেও ছাড়তে হয় কাজ। শীতের পোশাক ও বর্ষার ছাতার জন্য  অনেক মুখ ঝামটা সইতে হয়েছে তাকে। বিপদ কাটিয়ে সকালে হাজির হতেই জেনে গেছে  কাজটা তার চলে গেছে। পরে এসে পয়সা হিসেব করে নিয়ে  যেতে বলা হয়েছে। ব্যবহার করতে দেওয়া হয়নি পরিবারের বাথরুম। এই রকম  প্রভু-ভৃত্যের অবস্থান থেকেই কাকলী পালাতে চেয়েছিল। পয়সা আর সম্মান দুটোই যখন নেই তখন দেশের মাটি কামড়ে পড়ে থাকা কেন? তাই কাকলী পাড়ি দেয় দিল্লির অচেনা মাটিতে। কিন্তু কপাল সঙ্গ দিল না। লকডাউন ভাগ্যের রেখা বদলাতে দিল না।

কাকলী বলে, নিজের দেশে অনেক শিক্ষিত বাড়িতে কজ করেছি। কিন্তু সম্মান কোথাও  সেভাবে পাইনি। বাইরে সম্মান না থাকলেও টাকাটা বেশী  তাই ছুটেছিলাম। মা-ছেলে কাজ করে ভেবেছিলাম দিন বদল হবে। কিন্তু কাজের মেয়েদের কি তাই হয়? শিক্ষিত মানুষেরাই তো ভালবাসতে পারল না আমাদের । আমাদের এখনও
 অনেকে ছোটোলোকই ভাবে!  ঘর মুছি,বাসন মাজি কিন্তু কোনোদিন ও নিজের ডাইনিং টেবিলে বসে খেতে বলেনি কেউ। এমনকি যে সোফা প্রতিদিন ঝাড়ি-মুছি সেখানে বসতেও দেয়নি একদিন।  মার্বেলের বাথরুম পরিষ্কার করি কিন্তু একদিনও স্নান করতে দেয়নি কেউ। 

কাকলি দুঃখ করে বলে, " মান -সম্মান আমাদের নেই এটাই সবাই ভাবে। কাজের  অনুপাতে মূল্য পায় না সয়ে যায়। কিন্তু মানুষ হয়ে মানুষকে ছোট করে সেটাই খারাপ লাগে। অভাব তো আমাদের চিরকাল। লকডাউন শুধু ধার বাড়িয়ে দিল। হাত পাতা ছাড়া উপায় রাখল না কোনও।"

বহরমপুর ,মুর্শিদাবাদ।

Thursday 21 May 2020

অভিবাসী শ্রমিক প্রতিমা মোদকের তালাবন্দির দিন

 প্রতিমা মোদকের লকডাউন যাপন

চার ক্লাসে পড়া ছেলেটার মুখে খাবার তুলে দিতে পারছেনা প্রতিমা মোদক। কাজের সন্ধানে একদিন ঘর ছেড়ে পাড়ি দিয়েছিল। দিনহাটা থেকে উত্তরপ্রদেশ। মাস আনে মাস খায়। উপার্জনের টাকায়  চলে বাড়ি ভাড়া ও দৈনন্দিন খরচ। আট বছরের বেশি  সময় ধরে স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে বাস নাংলা চরনদাস,নয়ডায়। সংসারের অভাবের কথা ভেবেই লকডাউনের আগে মেয়েকে নিয়ে বাবা  ঘরে ফিরে আসে। ছেলে পাঁচ ক্লাসে ভর্তি হবে তাই মা ছেলেকে নিয়ে থেকে যায়! সেলাই ও  সুতো কাটিং করার কাজ ছিল প্রতিমার। দুই মাস ফ্যাক্টরি বন্ধ। এবার খাওয়ার টান। স্বামীও বেকার বসে  দেশের বাড়িতে। প্রতিমা একমাত্র ভরসা পরিবারে।

কোথায় কারা খাবার দিচ্ছে খুঁজতে খুঁজতে দিন কাটছে প্রতিমার। সন্ধ্যের আগেই এগারো বছরের ছেলেটাকে খাবারের পাত্র নিয়ে রাস্তা রাস্তা ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে। প্রতিমার কষ্ট সেটাই।বাড়ি ভাড়া ২৫০০ টাকা প্রতিমাস। সেটা টানতেই এখন  হিমশিম খাচ্ছে প্রতিমা। প্রায় চল্লিশ ছুই। শুনেছে কোম্পানী ছাঁটাই করবে। আর কি কাজ পাবে কোথাও নতুন করে? এদিকে ছেলের তো ক্লাস ফাইভ হবে এবার। প্রতিমা মোদক বলে, "এখন দুই বেলা দুমুঠো খাবারের বাইরে আর কিছুই ভাবতে পারছিনা।কাজ থাকবে কি? জানিনা। ছেলেটাকে তো বাঁচিয়ে রাখতে হবে।"



প্রতিমার বাবা কৃষিকাজ করতেন। চাষি পরিবারে মেয়ে।পড়ালেখা শেখাই হয়নি। নিজের মেয়েকেও অভাবের কারণে  টানতে পারেনি প্রতিমা। পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যায়। বাপ - মা বাইরে খাটে তাই মেয়ে ঘর সামলায়।  অচেনা জায়গায় ঘরে বসে পরিবার ও ভাইকে দেখাশুনা করতে গিয়ে মেয়েটাও এগোতে পারে না। তারপর  ছেলেকে মানুষ করার ভূত মাথায় চাপে প্রতিমার। দিনরাত এক করে তাই কাজ করেছে প্রতিমা। কে জানত লকডাউন এভাবে  পরিবারটাকেই রাস্তায় এনে ফেলবে! হাত খালি করে দেবে। প্রায় সাত হাজার টাকা বেতনের চাকরি পেয়েছিল  প্রতিমা। পি এফ ও নাকি কাটত কোম্পানী। কাজ চলে গেলে কি সে টাকা পাবে? চিন্তায়  রাতে ঘুমাতে পারছে না প্রতিমা।  জেগে জেগেই সকাল হয়ে যাচ্ছে। বাড়িতেও বাবা -মেয়েও খালি হাতে ফিরেছে। তাদেরও প্রতিমা কিছু সাহায্য করে উঠতে পারছে না। 

সবমিলিয়ে জীবন নিয়ে বেঁচে থাকাই দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে। একে নিজের দেশ নয়। অন্যদিকে কাজ নেই। হাতে পয়সা নেই।  খাবার কেনার ক্ষমতা নেই। এভাবে আর কতদিন!
আমপাড়া,দিনহাটা,কুচবিহার

Wednesday 20 May 2020

ক্যাটারিং ব্যবসায়ী পূর্ণিমা মণ্ডলের লকডাউনের দিন

ক্যাটারিং ব্যবসায়ী পূর্ণিমা মন্ডলের লকডাউন যাপন
কয়েকটা  বিয়ে ও একটি জন্মদিনের অর্ডার ছিল ক্যাটারিং এর। অনুষ্ঠান বাতিল হয়েছে লকডাউনের জন্য। বাকি  তিনটি  হয়ে যাওয়া অনুষ্ঠানের টাকা পাওয়া গেল না। সকলেই  "পরে দিচ্ছি" জানিয়ে দিল। ব্যবসায় টাকা ফেঁসে যাওয়ার যে  কি বিষ তা হাড়ে হাড়ে টের পেলেন ক্যাটারার ব্যবসায়ী পূর্ণিমা মন্ডল। মাত্র  তিন বছরের ব্যবসা একটু মাথা  তুলতেই নুয়ে পড়ল যেন! বন্ধ হওয়া অনুষ্ঠানের জন্য আগাম কিছু টাকাও খরচ হয়ে গিয়েছিল। সেই টাকা আটকে রইল। আবার নতুন করে অনুষ্ঠানের দিন কবে স্থির হবে একদম অজানা পূর্ণিমার। জীবনের নানা ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে একটু স্থিতু হয়েছিল পূর্ণিমা। স্বামীকে কিনে দিয়েছিল টোটো। ক্যটারারের ব্যবসায় নিজের ভাই ও স্বামীকে সঙ্গে নিয়েছিল। নিজের ক্যাটারিং এ যুক্ত  কর্মীর কাপড় কেচে দেওয়া ও হিসেবের খাতা দেখার জন্য লোক রাখেনি আলাদা করে। কিছুটা খরচ কমানোর ইচ্ছে থেকেই নিজেই দুই  হাতে কাজ করেছে এতদিন। কোথাও কোনও ঘাটতি রাখেনি সততার। ক্যাটারিং এর ব্যবসা ছিল পূর্ণিমার নিজের পরিবার।

ব্যবসা শুরুর  মাত্র বছর  দুই আগেই  পরিস্থিতি ছিল অন্যরকম। একদিন চুপিচুপি  স্বামী ও মেয়েকে নিয়ে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয় পূর্ণিমা। অভাবের সামনে পড়ে দিশেহারা হয়ে যায় । টানা ছয় মাস কোনো কাজ নেই স্বামীর হাতে। স্বামীও সায় দেয়। তিনজনেই বিষ খাবে। স্থির হয়। কিন্তু ভোর হবার আগেই বদলে ফেলে সিদ্ধান্ত। নিজেদের জীবনের মূল্য হারালেও মেয়ের প্রাণ বাঁচানোর দায় থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারে না পূর্ণিমারা। দুর্দিনে না খেয়ে থাকা থেকে শুরু করে  তিনজন তিনটে আলু সেদ্ধ খেয়েও দিন কাটিয়েছে। তারপরেও  চরম  অভাবের দিনে মেয়ের মুখের হাসির দিকে তাকিয়ে এই মন্ডল দম্পতি সিদ্ধান্ত বদলাতে বাধ্য হয়। নতুন সকালে নতুন করে শুরু করে পূর্ণিমারা। মেয়েকে মানুষ করার অদম্য আকাঙখা থেকে আবার যাত্রা শুরু। মেয়ের স্বপ্নে  বাবা-মায়ের নতুন সফর শুরু হয়। বেঁচে থাকার নতুন ইচ্ছা জাগে।



অষ্টম পাশ পূর্ণিমার স্বচ্ছল ও শিক্ষিত পরিবারেই বিয়ে হয়। কিন্তু স্বামী একটু বেপরোয়া হওয়ায় নানা জটিলতার মধ্যে দিয়ে দিন কাটে।  বাড়তি ঝামেলা এসে পড়ে একের পর এক। স্বামীর সাজা হয়ে যায়। জেল থেকে নিজের হাতে ছাড়িয়ে নিয়ে আসে। একা লড়ে যায় পূর্ণিমা। কিছুতেই হার মানে না । নিজের সব উজার করে  সংগ্রহ করে ক্যাটারিং এর ব্যবসার জন্য টাকা। ঋণ করে  নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে। তারপর স্বামীকে নিরন্তর উৎসাহ দেয়। ব্যবসায় গতি আসে। স্বামীর টুকটুক থেকেও আয় হতে থাকে টাকা। সবমিলিয়ে খুব সাফল্য আসে পূর্ণিমার নতুন ব্যবসায় ও পরিকল্পনায়।

লকডাউন লিখে দিল কপালে নতুন  বিপর্যয়। টুকটুক ঘরে  বসে থাকল দুই মাস । লকডাউনে অনুষ্ঠান একের পর এক বাতিল হল তাই  টাকা আটকে  থাকল। হাত হয়ে গেল  ফাঁকা। আরপরে লোনের মাসের টাকা মিটিয়ে  টাকা শেষ। নগদ টাকা কি করে যে হাতে ফিরে আসবে এবং  কখন তা নিয়ে একদম অন্ধকারে পূর্ণিমা। পূর্ণিমা বলে, "কি সংগ্রাম করে এই ব্যবসা করা,স্বামীকে বেঁচে থাকার পথ দেখানো বলে বোঝাতে পারবো না। জীবনের আশা যে ছেড়ে দেয়, তাকে জীবনে ফেরানো যে  কী কঠিন,সে আমিই জানি।" 

পূর্ণিমা বলে, "আমার  মত অনেকেরই সামনে কঠিন দিন আসছে। জানিনা কি করে কি হবে। আসলে টুকটুকটা চললে হয়ত কিছুটা সামাল দেওয়া যেত সংসার। লকডাউন এভাবে সুখের দিনে আগুন লাগিয়ে দেবে কল্পনাও করিনি।" পূর্ণিমা  বলতে শুরু করে মেয়ে আর স্বামী নিয়ে কিভাবে ব্যবসাটা মেয়ের নামেই শুরু করেছিল । অনেকটা সামনের দিকে এগিয়েও গিয়েছিল। এখন থমকে। আগামীতে শুধু অনিশ্চয়তা আর অন্ধকার। 

অন্যমনস্ক পূর্ণিমা বলে,"এত বছরের দাম্পত্যের সুখ শান্তি কেড়ে নিয়েছে এই লকডাউন। একটিই জীবন,কতবার শুরু করা যায়!"
ভাকুড়ি,মুর্শিদাবাদ

Monday 18 May 2020

অভিবাসী শ্রমিক সন্ধ্যারানির লকডাউনের দিন

 সন্ধ্যারানি সাঁতরার লকডাউন যাপন 
কারা যেন খাবার বিলি করছে শুনে ছুটে যায় সন্ধ্যা সাঁতরা। বাটি নিতে ভুল হয়ে গিয়েছিল সন্ধ্যার । আবার মাঝরাস্তা থেকে ফিরে আসে। এবারে বাটি নিয়ে  লাইনে দাঁড়াতেই  খাবার শেষ। সন্ধ্যার আজ আর খাবার জুটল না। নন্দীগ্রামের সন্ধ্যারানি সাঁতরার জীবনটাই একটা উপন্যাস। লকডাউনে পাতা গুলো উল্টেপাল্টে বেরিয়ে এল। স্বামী মারা গেল  কুড়ি বছর আগে। বাপের বাড়ি ও শ্বশুরবাড়ির সবাই মুখ ফিরিয়ে নিল। সোজা নন্দীগ্রাম থেকে পাড়ি দিল উত্তরপ্রদেশের নয়ডায়। জলপাই থেকে  গৌতম বুদ্ধ নগর এর সফরটা খুব সহজ ছিল না।  নানা জায়গায় কাজ করে অবশেষে ভাগ্য খুলে যায় সন্ধ্যার। একটা রেডিমেট গার্মেন্টস কোম্পানীতে কাজ পায় সন্ধ্যা। নতুন কাজে খুব ভালো চলতে থাকে সব। আড়াই হাজার টাকা দিয়ে ঘর ভাড়া নেয় সন্ধ্যা।  ছুটি না নিলে আয় হতে থাকে মাসে আট হাজার টাকা। লকডাউনের আগেই উনিশ দিনের টাকা দিয়ে দেয় কোম্পানী। সেই টাকা দিয়ে ঘর ভাড়া ও সংসার চলে যায় সন্ধ্যার। এবারে সমস্যার শুরু। সন্ধ্যা আর চালাতে পারছে না। প্রতিদিন বাটি হাতে লাইন দিয়ে খাবার নিতে যাচ্ছে। কোনোদিন পাচ্ছে। কোনোও দিন পাচ্ছে না। মুশকিল হল লকডাউনে কোম্পানী খুলেছে কিন্তু সন্ধ্যার ডাক পড়েনি। খুব অল্পসংখ্যক কর্মী নিয়ে ফ্যাক্টরি কজ চালাচ্ছে। সন্ধ্যা বড় আশা নিয়ে প্রতিদিন যাচ্ছে আর ফিরে আসছে। সন্ধ্যা কেঁদে বলে, "সব দুঃখ সহ্য করেছি, লাইনে দাঁড়িয়ে হাত পেতে খাবার নিচ্ছি। আমার এই একযুগ ধরে খেটে খাওয়ার জীবনে এমন খারাপ সময় দেখিনি।"



সন্ধ্যা  মাত্র চার ক্লাস পাশ  করেছিল।  স্বজন হারিয়ে বিদেশে এসে বাস করছে।  বাংলায় কথা বলার কেউ নেই।  নিজের খেটে খাওয়ার উপর ভরসা ছিল।  তাই কখনও ভয় পায়নি। এখন খুব উদ্বেগের সঙ্গে দিন কাটছে।  খাবার নেই, চেনা লোক নেই। একা ও অসহায় হয়ে পড়েছে সন্ধ্যা। নিজের উপার্জনেই মেয়ের বিয়েও দেয়। যাবতীয় সাংসারিক দায়িত্ব মাথায় তুলে নিয়েছে একের পর এক। এখন নিজের কাছেই নিজে বোঝা হয়ে গেছে। ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলছে। কাজটা যদি ফিরে না পায় সেই আশঙ্কাও মাথায় চড়ে বসেছে। বয়স পেরিয়েছে পয়তাল্লিশ। আর কি কাজ পাবে কোথাও? মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে সন্ধ্যার। সন্ধ্যারানি সাঁতরা কাজ ছেড়ে মেয়ের কাছে থাকবে সে ইচ্ছাও নেই। জামাই এর বোঝা হতে চায় না। বাড়ি ভাড়া গত দুই মাসে মিটিয়েছে। আগামীতে কি হবে জানেনা সন্ধ্যা। 

এই লকডাউনে সন্ধ্যার মত মহিলাদের  সম্মান নষ্ট করে দিল। নিজের উপার্জনের অহংকার কেড়ে অন্যের সহানুভূতি ও দয়ার পাত্র করে দিল। সন্ধ্যা আপশোস করে, "নিজের জোরেই কাজ খুঁজেছি, নিজের জোরেই পড়ে আছি বাইরে কিন্তু এই লকডাউনে পরভরসা হয়ে গেলাম।" 

সন্ধ্যার ফেরার পথ নেই ঘরে। ওখানে রুজি-রুটির অনিশ্চয়তা এনে দিয়েছে লকডাউন। কাজ করা খেটে খাওয়া মেয়ের থেকে মুখ ঘুরিয়েছে অনেক আগেই আত্মীয় -পরিবার। এখন এক অনিশ্চিত জীবনের সঙ্গে ঘর। সন্ধ্যা ভাঙা গলায় বলে, "একটু সাহায্য করবেন?" একথাটা বলতে গিয়ে গলা বন্ধ হয়ে আসে সন্ধ্যারানি সাঁতরার।  কষ্ট করে বলে, "জগতে মেয়েদের জন্য সবকিছু খুব কঠিন।"
 জলপাই,নন্দীগ্রাম,পূর্ব মেদিনিপুর।

Friday 15 May 2020

গামছা বুননের কারিগর আসমা ও বৃষ্টি মন্ডলের লকডাউন যাপন

আসমা ও বৃষ্টির লকডাউনের দিন

এখন ঘরে কুড়ি কেজি চাল। শাক-পাতা তুলে নিয়ে চলছে হাঁড়ি। রান্না তেল ছাড়াই। আখার জ্বালানি বলতে  পড়ে পাওয়া শুকনো পাতা ও লকড়ি। আসমা মন্ডলের সংসারে লকডাউন এভাবেই থাবা বসিয়েছে। গামছা বুনে আয় হত মাসে তেরোশো টাকা। সেই টাকাতেই দুই মেয়ে নিয়ে সংসার আসমার। স্বামী  অসংগঠিত শ্রমিক। মাঝে মাঝে কাজে যায়। ফিরে আসে হাজার - বারোশো টাকা নিয়ে। লকডাউনের আগে নিয়ে এসেছে মাত্র ছ'শো টাকা। সংসারের ভার আসমার উপরেই ছিল বরাবর। লকডাউনের ঘোষণায় বন্ধ হয়েছে  গামছার কাজ। এদিকে ছাদ  থেকে পড়তেই আছে বৃষ্টির জল। মেরামতের নেই সামর্থ্য। লকডাউন চলছেই। নিরুপায় হয়ে  তুলে দিতে হল  ঘরে বসানো গামছা বুননের তাঁত।


   
বাড়িতে অভাবের কারনে বৃষ্টির স্কুলের মুখ বেশিদিন দেখা হয়নি। দ্বিতীয় শ্রেণিতেই ইতি টানতে হয়। মায়ের সঙ্গে গামছা বুনানোর সহযোগিতায় পেরিয়ে যাচ্ছে শৈশব ও কিশোর বেলা। আসমার লোক দিয়ে পয়সা রাখার মত আর্থিক ক্ষমতা ছিল না। তাই দুই মেয়েকেই উপার্জনের কাজে  লাগাতে হয়। খিদে মেটাতে বিদ্যালয়ের হাতছানি উপেক্ষা করতে হয় বৃষ্টি ও সাগরিকাকে। পরিবারের পেট চালাতে দুই মেয়ে শিক্ষিত হতেই পারল না! আসমা কষ্ট পেয়ে বলে,"দুই মেয়ে আর আমি মুক্ষু-সুক্ষু থাকলাম। জন্ম থেকেই অভাব। তারপর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। আবার সেই  অভাবের সঙ্গেই ঘর।" 

সারাবছর প্রায় তেল ছাড়াই চলে রান্না তা নিয়ে কষ্ট নেই আসমার। মেয়েকে বিদায় করতে হল এই লকডাউন ঘোষণার সময়। সে নিয়ে জ্বালা আছে আসমার । দুই মেয়েকে ঘরে সামলে রাখার জন্য যে ঘর চাই সেটাও তার নেই। আসমা বলে "বাপ তো প্রায় থাকে না । আমি একা কত দেখবো। কিছু হয়ে গেলে কে দেখবে? তাই চেষ্টা করছিলাম বিয়ে দেওয়ার। আসমা বলে,"খাবারের অভাব। ভাঙা বাড়ি। মেয়েকে আগলে আর কদ্দিন রাখতে পারবো? একটা মাথা কমে গেলে হাঁড়িতে চালও কম লাগবে। শ্বশুরবাড়িতে নিরাপদ থাকবে।  

প্রান্তিক জীবনের এই আর্থিক দুঃখ-দুর্দশা অন্তহীন। জরাজীর্ন বাড়ি,ভেঙে পড়া ছাদ,মলিন শাড়ি, জানালায় অত্যন্ত সুনিপুন হাতে সেলাই করা চালের বস্তার পর্দা- এসব কিছুই এই রুক্ষ চুলে ছিপছিপে রোগা চেহারার আসমাকে পরাস্ত করতে পারেনি। নিঃস্ব জীবন কিন্তু নিরানন্দ নয়। পায়ে ছিঁড়ে যাওয়া চটি কিন্তু অভিযোগ নেই কোনও। হাতে পাঁচ টাকা নগদ নেই । কিন্তু অনাহারে ভয় নেই।  এই সরল মানুষ গুলো সবার আগে গিয়ে লাইন দিয়ে ভোট দেয়। গণতান্ত্রিক সরকার গঠনে এদের বিনোদন বিহীন সততা সবচেয়ে বেশি। কিন্তু একপুরুষ তারপর দুইপুরুষ চলে যায় এদের জীবনে আড়ম্বর ফেরে না। এদের ঘামের গন্ধ ভালোবাসা সম্বলিত ভাষণ দিয়ে চোখ জুড়ানো পোশাকে দেশনেতা সমাপ্তি টানেন। আর ওই টিলার উপরে একখান ঘরে অনাহার,রোগ নিত্যদিন ঘর বাঁধে। হাঁড়িতে ভাত না থাকার সত্যটা কেমন যেন গল্পের মত শোনায়। লক্ষ -কোটি টাকার যোজনা ও পরিকল্পনার হুংকারে চাপা পড়ে যায় আসমাদের বাদ ছেঁড়া অর্ধেক  হাওয়াই চটির বাস্তব। ঢেকে যায় ভেঙেপড়া ছাদের মধ্যে দিয়ে ঢুকে পড়া জলের রাতে বৃষ্টি দিয়ে ভাত মাখানোর দীনতা। লকডাউনের দিনে বৃষ্টিই তরকারীর অভাব পূরণ করে আসমা মন্ডলের সংসারে। যে যেখানে দাঁড়িয়ে আসমাদের দেখে। এবং  ভুলেও যায়। কিন্তু চোখের কোন থেকে আসমা-সাগরিকা-বৃষ্টিদের  বিশ্বাসের রেখাটা কিছুতেই মিলিয়ে যায় না!         
 
হরিহরপাড়া,তর্তিপুর,মুর্শিদাবাদ
 

Wednesday 13 May 2020

সোনালি হাজরার তালাবন্দির দিন

 সোনালির লকডাউন যাপন

"সরকার এত সাহায্য দিচ্ছে শুনছি। কিন্তু আমাদের লোনের এই তিনমাসের  টাকাটা মুকুব করে দিতে পারে না?" সোনালি  হাজরার এখন এটাই জিজ্ঞসা। পনেরো বছর ধরে সোনালি পাটের ব্যাগ ও ম্যাট তৈরি করে। লকডাউনের জন্য ঘরে পড়ে থাকল প্রায় হাজার তিরিশের  তৈরি জিনিষ। কলকাতায় মেলাতে যাওয়ার জন্য তৈরি ছিল বাড়তি মাল। সেটাও বাতিল হয়েছে। তাই ব্যাগ, ম্যাট যাবতীয় জিনিষ ঘরবন্দি। পাইকারী বিক্রীর উপায়ও বন্ধ। প্রতিদিন দলের মেয়েদের অভাব-অভিযোগ শুনে একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে সোনালি। নিজের পরিবারে অশান্তি কি কম! স্বামী লেবার। তিন জায়গায় অন্তত বারো হাজার টাকা পাবেন। কিন্তু হিসেব করেও পেলেন না টাকা। এখনও দিচ্ছি ও দেবো চলছেই।



বিয়ে করে  সোনালি এসেছিল পাকা ঘরে। শাশুড়ি স্বনির্ভরগোষ্ঠীর দৌলতে গেঁথে ফেলেছিল ইটের দেওয়াল। কিন্তু সেই ঘরে অভাব কখনও এসে পড়বে ভাবেনি সোনালি। ঘরে রেশনের  চাল আছে। আটাও আছে। বাকি কিছু কেনার ক্ষমতা নেই। সোনালি আপশোস করে বলে,"ইটের দেওয়াল থাকলে কি অভাব থাকে না দিদি? গ্যাসের পাশে যে আখার উনুন সেটাও খুব বড় সত্যি। পঞ্চাশ দিন বাড়িতে বসে। আমার কাজও বন্ধ অনেকদিন। টাকা কোথায় পাবো?"

সবিতার ছোট ছেলে মাত্র দ্বিতীয় শ্রেণি। সে তো কিছু বোঝে না। নবম শ্রেণির বড়টা একটু অবস্থা বুঝলেও ছোটটি একেবারে অবুঝ। তাই প্রতিদিন খাবার নিয়ে অশান্তি চলছেই। তাতে সোনালি খুব বেশী বিব্রত নয়। কিন্তু গোষ্ঠীর মেয়েরা উপকৃত হলেও আসল উদ্দেশ্য থেকে অনেকেই সরে আসছে। এই নিয়ে সোনালি বেজায় ভাবিত। গোষ্ঠীর অনেক মেয়েই যে ঋণ নিচ্ছে তা দিয়ে মেয়ের বিয়ে দিচ্ছে। নইলে সংসার চালাচ্ছে। টাকা জীবনের কাজে লেগে যাচ্ছে। জীবিকায় সক্ষমতা ও বাড়তি আয় বাড়ানোর কাজটা বাকি পড়ে থাকছে। তাই সামাজিক পরিবর্তন ও গ্রামের উন্নতির ভাবনা অনেকটাই পেছনে পড়ে রয়েছে। 

সোনালি বলে,"স্বনির্ভরতা ও সক্ষমতা আর এক কথা নেই গো দিদি! সরকার যাদের স্বনির্ভর করার কথা বলছে তারা কি সক্ষম হতে পেরেছে? আজ আমি তো সক্ষম নই! এমন অবস্থা চলতে থাকলে আমাকেও কাল অন্যের সাহায্যে নিয়েই বাঁচতে হবে। সম্মানের আড়াল আর থাকবে না! কিন্তু আমি তো খেটেই খাই।" 

লকডাউনের মত পরিস্থিতি সোনালিদের অভাবি বানায়। তাই এই অসময়ে সরকারের কাছে হাত পাতা ছাড়া আর কি করতে পারে সোনালিরা ? সোনালি বলে, "অসময়ে সম্মান বাঁচানোর জন্য যদি গোষ্ঠীর মেয়েদের কোনও পলিসি বা বীমার আওতায় এনে ফেলত তবে মুখ রক্ষা হত।সারাবছর খেটেও যদি ধার করে খাই বা শোধ দিতে না পারি কেমন লাগে বলুন?"

সোনালির এই খারাপ লাগা একার নয়। লকডাউনের জন্য  স্বনির্ভর গোষ্ঠীর অনেক মেয়েদের এই  খারাপ লাগা নিয়ে চলতে হবে আগামী দিনে। মাসের মিটিং এবং  হিসেবের খাতা সব বন্ধ পড়ে। ফিল্ডে পড়ে আছে অনেক টাকার জিনিষ। ডেলিভারী না দিতে পারলে আবার সেই নতুন  ঋণের ফাঁদ। আবার সেই শোধ করতে না পারার হাহাকার। আবার সেই অক্ষমতার গল্প প্রতিদিন বারান্দা-চৌকাঠ জুড়ে।     
হাজরাপাড়া ,ইসলামপুর,মুর্শিদাবাদ     

Tuesday 12 May 2020

রেফুল রুপেন,পানফুল দাদির তালাবন্দি জীবন

 দাদিদের লকডাউন যাপন
  
এই লকডাউনে সেহেরি আর ইফতারের মাঝের দৈনন্দিন জীবনটুকু গায়েব হয়ে গেছে তিন দাদির। শ্যুটার চন্দ্র আর প্রকাশ তোমর দাদিদের মত রেফুল,পানফুল, রুপেন দাদিরা মাথা তুলতে পারেনি। ওদের নিয়ে তাই 'ষান্ড কি আঁখ' এর মত সিনেমাও তৈরি হবে না। গল্প লেখাও হবে না। শাহিনবাগের দাদিদের মতও ঘর ছেড়ে রাস্তায় প্রতিবাদে শামিল হওয়া হয়নি রেফুল দাদিদের। এই দাদিরা গ্রামের এক এক প্রান্তে পড়ে থেকে অস্তিত্বের লড়াই লড়ছেন। কাজে বিড়িশ্রমিক। পরিচয়ে দাদি। প্রায় দুই যুগ ধরে স্বামীর ভিটা আগলে। ছেলেরা নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। বাপের ভিটাতেই আলাদা হয়ে থাকতে হচ্ছে মাকে। লকডাউনেও মায়ের মুখে একটুকরো রুটি তুলে দেয়নি ছেলেরা। মাও নাছোড়। ভিটাতেই ত্রিপল টাঙিয়ে পড়ে রয়েছে এক কোনায়। বিধবা ভাতার কথা শুনে হাসিই থামে না কানফুল দাদির। বলে "দুইবার না তিনবার ভাতা পেয়েছিনু কিসের জানিনা! ২৫ বচ্ছরের বিধবা আমি। পায়সা আছে এত সরকারের হামারঘে পুষার।"

রেফুল দাদির স্বামী দুই বছরের বাচ্চা রেখে মারা গেছেন। দীর্ঘ পঁচিশ বছর দাদি একাই সামলেছে সব। ছেলে বিয়ে করে মায়ের হাড়ি ভিন্ন করে দিল। মাটি কামড়ে ভিটাতেই পড়ে রইল দাদি। লকডাউনের দুর্দিনে ইফতারে মাকে ভিজা ভাত খেতে দেখেও ছেলে ছুটে আসে না একটিবার। তারপরে ছেলেকে বাপের ভিটা ছেড়ে দিয়ে মায়ের ভিটাতে আশ্রয় নিল রেফুল দাদি। দাদি বলে,"বিড়ি ইচ্ছা হলে বাঁধি,চোখে দ্যাখতে পাই না। বাদ চলে যায় বিড়ি। পায়সা কেটে নেয় মুন্সির লোক।" চোখে জল নিয়ে দাদি বলে " ভালো-মন্দ খ্যাতে দেয় না কেহু। তাতে কি জান আটকাবে? চেহে -চিন্তে চলছে। পায়সা নাই ওষুধের, জল -পানি মিলে না সবসময় তাও গরীবের ধক বেশি।"



কানফুলের স্বামী নাই কুড়ি বছর। বিড়ি বেঁধে যে ছেলেকে মানুষ করা সেই ছেলে ভিন্ন করে দিল মাকে। সুগার, প্রেসার নানা অসুখে জেরবার পানফুল দাদি। ছেলে হাঁড়ি আলাদা করতে বললে মানে লাগে কানফুলের। অভিমানে বিড়ির কুলায় বসে বিড়ি বাঁধতে বাঁধতে ঘুমিয়ে পড়ে। কতটুকুই বা খেতে পারে সে! বলে, "সারাজীবন একা থাকলাম ছেলে বুকে করে। কিন্তু সেই ছেলেই ছুঁড়ে ফেলে দিল। আজ এই বিপদেও পাশে কেউ থাকল না।" কানফুল দাদি বলে, "তাই বলে কি হাত গুটিয়ে লুকিয়ে যাবো? লকডাউনেই বাড়ী বাড়ী ঘুরে কিছু না কিছু পেটের জোগাড় করে আনি প্রতিদিন।"



রুপেন দাদির স্বামী তিন বছরের ছেলে রেখে মারা গেল। প্রায় ২৪ বছর ধরে একা হাতে ছেলেকে মানুষ করলেন দাদি। বিড়ি বেঁধেই সংসারের হেঁশেল বাঁচল। বিয়ে করে ছেলে ভিন্ন করে দিল মাকে। এতদিনের সংগ্রাম এক নিমেষে মিশে গেল মাটির সঙ্গে। তীরে এসে তরি ডুবে গেল রুপেনের। সুখের দিন দেখার কথা ছিল। ছেলে বড় হয়ে মাকেই দেখবে এটাই তো প্রকৃতির নিয়ম। হল না।



এই দাদিরা অত্যন্ত কম বয়সে মা হয়েছেন। দাদি হয়ে পরের প্রজন্ম তাদের ছুঁড়ে ফেলার বাইরে কিছুই করল না। দাদিরা জীবনের সব ধর্ম পালন করেলেন বীনা প্রশ্নে। শুধু প্রতিদান পাওয়ার বেলায় হাত শূন্য থেকে গেল। বয়স ও একাকীত্বের ভারে নানা অসুখ বাসা বেঁধে চলেছে একের পর এক। রটি,কাপড়া,মকানের লড়াই এ নিঃশেষ হয়ে গেলেন দাদিরা। মাথার উপরের ছাদটাও অধরা রয়ে গেল। সামাজিক নানা অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে দাদিরা। এবারের লকডাউন সম্মানটুকু কেড়ে নিল। বেরিয়ে পড়ল অভাবের ক্ষত। অভাবের সঙ্গে সম্মানের নয়, অধিকারের সম্পর্ক। এটকু নিশ্চিত করার কেউ নেই দাদিদের সামনে। সৎভাবে বাঁচার ইচ্ছাটাই আত্মসম্মান। আর সেই পথে দাদিরা প্রথম শ্রেণির নাগরিক। আত্মসুখ বিসর্জন দিয়ে জীবনের বেঁধে দেওয়া নিয়মের সামনে এভাবে আত্মসমর্পণ করতে ক'জন পারে! তবু এই ঠাকুরমাদের ঝুলি থেকে গল্প নয়, শুধু কান্না বেরিয়ে আসে। জীবনের সব বিচ্ছিন্নতাকে সাদরে স্বীকার করেছেন দাদিরা। অভিযোগ করেননি কোথাও। শুধু লকডাউনের দিনগুলো গলায় মাছের কাঁটার মত আটকে থাকল।

দস্তামারা,জঙ্গীপুর,মুর্শিদাবাদ।







Monday 11 May 2020

সাপুরিয়া সন্ধ্যার লকডাউনের দিন

সন্ধ্যা সাপুরিয়ার লকডাউন যাপন
সরকারের ঘর থেকে পাওয়া রেশনের চাল বাজারে বিক্রী করতে বাধ্য হল সন্ধ্যা সাপুরিয়া। গ্রামের দোকানে দোকানে ঘুরে স্বামী লালু সাপুরিয়া বিক্রী করে দিল চাল। মাত্র কুড়ি  টাকা কেজি দরে। নইলে  এই লকডাউনে নাতিদের খাবার ও নিজের সুগারের ওষুধ চালানো সম্ভব ছিল না। মাথাপিছু সাত কেজি করে চাল পেয়েছে সন্ধ্যা সাপুরিয়ার পরিবার। পাতে তরকারির কথা ভাবছেই না এখন। চাল আর আটাটুকুই সব।

নিজের হাতে সাপ ধরেছেন সন্ধ্যা তিন মাস আগেই। বাড়ির পাশের মাঠেই সাপ বেরিয়েছিল চন্দ্রবোড়া। নিজের বাবা ও দাদুর কাছেই হাতে সাপ ধরতে শেখার প্রশিক্ষণ সন্ধ্যার। ৯০ সালে কাদি,নবগ্রামে সাপ ধরতে গিয়েছে নিয়মিত সন্ধ্যা। খরিস,চন্দ্রবোড়া,কালাচ ধরেছে পুরুষ সাপুরিয়াদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। প্রতিদিন বাইরে যাওয়ার দিন। তখন  সন্ধ্যাদের জীবন ছিল অন্যরকম। 



অতীতের  স্মৃতিতে ভেসে যায় সন্ধ্যা। সন্তানের মত প্রিয় সাপ। সদ্য জন্মানো বাচ্চা সাপকে খাওয়ানো। রোদে শুকানো।  নিয়ম করে খোলস ছাড়ানো। বাজার থেকে পছন্দের খাবার  মাংস ও ডিম আনা। সন্ধ্যা সাপুরিয়াদের দিনযাপন  থেকে কি যেন হারিয়ে গেছে  আজ ! হাতে তৈরি  সাপের বাক্স আছে। বাচ্চারা নেই। সাপ ধরার অনুমতি নেই। খেলা দেখানোর অবস্থা  নেই। তাবিজ বানানোর তাড়া নেই। শুধু  খালি বাক্সের দিকে তাকিয়ে স্মৃতিচারণা। সন্তান কাছে না পাওয়ার  যন্ত্রণা নিত্যসঙ্গী। অভ্যাসের  দুপর অলস। পড়ন্ত বিকেল শূন্য। দিন যায়। সন্তানকে  ঘরে পায়না। স্বামী-সন্তান  ও নিজের কয়েকটা সাপ নিয়ে কাটত বেশ দিন সন্ধ্যা সাপুরিয়াদের। এখন বদলে গেছে সব। অন্য মানুষ সাপ ধরে নিয়ে যায়। সন্ধ্যা  সাপুরিয়দের মন হু হু করে। যে  সাপ সন্তান, তাদের  ঠিক দেখাশুনা করার লোক আছে হয়ত। কিন্তু তাদের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে যেন!

সন্ধ্যা সাপুরিয়াদের জীবন-জীবিকার সংকট কাটছেনা প্রায় দুই যুগ ধরে। স্বামীদের লাইসেন্স  এখনও আটকে রয়েছে দপ্তরে। সর্পগন্ধা দিয়ে তৈরি মাদুলি  আর তারা বিক্রী করে না। আন্টিভেনম তৈরিতে নেই  সাপুরিয়া পরিবারের কোনও যোগদান।  ওঁদের কাজে লাগিয়ে  হয় সর্প প্রদর্শনী। লেখা হয়েছে বইও। হাজার আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতি ফাইলবন্দি। কিন্তু মহিলা সাপুরিয়ার কোল খালি পড়ে। জীবিকার সন্ধানে মেয়েরা  লেখাপড়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। স্বামী রাজমিস্ত্রীর কাজ করছে। ভাই দোকানে কাজ করছে। কোথাও অধিকার হারানোর যন্ত্রণা তাদের পায়ে পায়ে জড়িয়ে ধরছে। তীক্ষ্ণ বেদনায় বিদ্ধ হচ্ছে মেয়ে সাপুরিয়ারা। আতর্নাদের ভাষা সকলের এক - “আমাদের সন্তান মরছে। আমাদের ডাকা হয়না। সন্তানদের নেই নিরাপত্তা। আজও  গড়া হলনা  সাপদের যোগ্য  বাসস্থান।"

সন্ধ্যা বলে,“সাপকে কে না ভয়  পায়! স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীও  সাপের ভয়ে কলকাতার এক পার্কে হাঁটতে যেতেন না বলে  শুনেছি। শুধু আমরাই পাই না। সরকার  যদি একটু সদয় হয় মেয়ে সাপুরিয়া দের প্রতি। জীবনদায়ি  ওষুধ তৈরি হচ্ছে। বাইরে থেকে আনা হচ্ছে বিষ। জীবন বিপন্ন হচ্ছে মানুষের এবং সাপুরিয়া মায়েরা বিপন্ন হচ্ছে। তাছাড়া খালি হাতে সাপ ধরায় সমস্যায় পড়তেও হয়েছে বহুবার। কামড় খেয়ে নিজেদের মধ্যে ব্যবহৃত চিকিৎসায় ভরসা করেন সাপুরিয়া মায়েরা। তাই জরুরি  সর্পবিদ্যা অধ্যয়ন ও প্রশিক্ষণের  জন্য কলেজ।"
                  
সন্ধ্যার বয়স বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে অসুখও বাড়ছে। এদিকে রোজগার বন্ধ। মন খারাপ করে বলে, "হাত গুটিয়ে বাড়িতে বসে স্বামী ও দুই ছেলে। মুখে মাস্ক পরে বসে আছে। সারাদিন হাত ধুয়েই কাটছে। বাজার হাটের পয়সা নেই। রেশন না পেলে এ যাত্রায়  মরে যেতাম। ঘরে বসে পেটটা তো  চলছে  কিন্তু কতদিন আর চলবে  জানিনা! " 

  মোড়গ্রাম,সাঁকোবাজার, সাগরদিঘী,মুর্শিদাবাদ













Sunday 10 May 2020

অভিবাসী শ্রমিক কন্যা সবিতা ও কবিতার লকডাউন যাপন


সবিতা ও কবিতা মুর্মূর লকডাউন যাপন


সবিতা মুর্মূও কবিতা মুর্মূ। বয়স মাত্র চার ও সাত বছর। আমবাগানে দাঁড়িয়ে। বাবার জন্য অনন্ত অপেক্ষার দিন শুরু। বাবা দিলীপ মুর্মূ অভিবাসী শ্রমিক। ঝাড়খন্ড থেকে এসেছিলেন মুর্শিদাবাদ। ধান কাটার কাজে। সাপের কামড় খেয়ে ভর্তি হয়েছিলেন হাসপাতালে। সবিতা ও কবিতার মা নেই। বাবার সঙ্গে এসে আমবাগানের ছাউনিতেই ছিল দুই বোন। দিন চারেক আগে সাপে কামড়ে দেয় দিলীপ মুর্মূকে। দুটি ফুলের মত জীবনকে অতলান্তিক জলরাশির মধ্যে ভাসিয়ে দিয়ে হাত ছাড়লেন বাবা। চারদিনের লড়াই শেষমেশ একেবারে অনাথ করে দিল সবিতা ও  কবিতাকে। দিলীপ মুর্মূর শরীর জাগতিক  লড়াই ছেড়ে পাড়ি দিল অমর্ত্যলোকে। মা হারা দুই শিশু এবার বাবা হারিয়ে পড়ে রইল ভিনদেশের অচেনা গাঁয়ে।সবিতা মুর্মূও কবিতা মুর্মূ। বয়স মাত্র চার ও সাত বছর। আমবাগানে দাঁড়িয়ে। বাবার জন্য অনন্ত অপেক্ষার দিন শুরু। বাবা দিলীপ মুর্মূ অভিবাসী শ্রমিক। ঝাড়খন্ড থেকে এসেছিলেন মুর্শিদাবাদ। ধান কাটার কাজে। সাপের কামড় খেয়ে ভর্তি হয়েছিলেন হাসপাতালে। সবিতা ও কবিতার মা নেই। বাবার সঙ্গে এসে আমবাগানের ছাউনিতেই ছিল দুই বোন। দিন চারেক আগে সাপে কামড়ে দেয় দিলীপ মুর্মূকে। দুটি ফুলের মত জীবনকে অতলান্তিক জলরাশির মধ্যে ভাসিয়ে দিয়ে হাত ছাড়লেন বাবা। চারদিনের লড়াই শেষমেশ একেবারে অনাথ করে দিল সবিতা ও  কবিতাকে। দিলীপ মুর্মূর শরীর জাগতিক  লড়াই ছেড়ে পাড়ি দিল অমর্ত্যলোকে। মা হারা দুই শিশু এবার বাবা হারিয়ে পড়ে রইল ভিনদেশের অচেনা গাঁয়ে।মলকডাউনের মধ্যেই তাদের তালাবন্দি ভাগ্যের  চাবি গুম হয়ে গেল। 


শৈশব ঝরে গেল অকালে। সামনে এই বিস্তর পথ হাঁটার জন্য একটি স্নেহের আঙুলও রইল না পথ দেখানোর। বাবার মজুর জীবন ক্ষেতেই শেষ হয়ে গেল। শ্রমিক সন্তানরা পথের শুরুই দেখতে পেল না। অসুখের মুখ দেখার আগেই জীবনের আয়নাটা সরে গেল!   

কুলগাছি,ডাঙাপাড়া,ভগবানগোলা

Saturday 9 May 2020

রাঁধুনি সাগরিকার লকডাউনের দিন


সাগরিকার লকডাউন যাপন

লকডাউনে রান্নার কাজ বন্ধ হয়েছে সাগরিকার অনেকদিন। আগে রান্নার কাজ করত বাড়িতে। তারপর মাসে দুই হাজার  টাকার বিনিময়ে এক বেসরকারি অফিসে রান্নার কাজ ধরে। সাগরিকাকে অভাবের বাইরে তাড়া করে নিয়ে বেড়াচ্ছে অন্য এক সমস্যা। দিনে দিনে তা বেড়েই চলেছে। শোকে-তাপে-চিন্তায় সাগরিকা বাড়িতে এখন শয্যাশায়ী। বিছানাই তাঁর সংসার। আগে তা-ও কিছু মুখে দিচ্ছিলেন। এখন সে সবও বন্ধ। পনেরো বছর আগে, বলা নেই, কওয়া নেই, স্বামী হঠাৎ হারিয়ে গেলেন!সেই ধাক্কা সামলে নিয়েছিলেন সাগরিকা। সন্তানের মুখ চেয়ে। মেয়ের মুখ চেয়ে। স্বামী নেই। সন্তান তো আছে। তাকে আঁকড়েই না হয় কাটিয়ে দেবেন জীবনের বাকি দিনগুলো। মেয়েটাও লেখাপড়ায় বড় ভাল। খুশির হাওয়া ছিল সংসারে। কিন্তু জানুয়ারিটাই যেন নষ্টের মূলে! সেই যে মেয়ে টিউশন নিতে গেল, আর ফিরল না। সাগরিকা প্রথমে ভেবেছিলেন, ভগবান বুঝি শেষ সম্বলটাও কেড়ে নিলেন।


কিন্তু, পরে তিনি জানলেন, ভগবান নয়, মেয়েটাই চলে গিয়েছে। স্বেচ্ছায়, নাকি চাপে তা জানেন না সাগরিকা। তাই তিনি দৌড়ঝাঁপ শুরু করলেন। খুঁজে পেলেন মেয়ের সঙ্গীর ঠিকানা । সেখানেই গিয়ে মেয়ের খোঁজ করলেন। কিন্তু ব্যর্থ হলেন। প্রথমে নিরুদ্দেশের ডায়েরি। তার পরে সেই আইনেরই আশ্রয়। মেয়েটাই তো তাঁর সব। জীবনের শেষ সম্বল।

জানুয়ারি মাস থেকে নেই নেই করে অন্তত ৬০ বার ছুটেছেন নানা দফতরে। না,হন্যে হয়ে খুঁজেও  হদিস পেলেন না মেয়ের কোনোও। লকডাউনের গেরোয় কিছুই আর নাকি হওয়ার নেই। জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে মেয়েকে পাওয়া যাচ্ছে না। এই শুনে  মায়ের মন কি মানে! জলজ্যান্ত বারো ক্লাসে পড়া মেয়েটা হারিয়ে যাবে? এ কেমন কথা!  সাগরিকার একটিই ভয়, এই বিপদের দিনে মেয়েটার যদি কিছু হয়ে যায়? একেই রোগ ছড়িয়ে রয়েছে চারপাশে! অন্যদিকে, মেয়েটারও উচ্চ মাধ্যমিক দেওয়া হল না!

হতাশ সাগরিকা বলছেন, "লকডাউন তো আজ শুরু হয়েছে। মেয়েকে পাচ্ছি না সেই জানুয়ারি থেকে। আমরা গরিব বলে কি মেয়েটা বেঁচে আছে কিনা তা-ও জানতে পাব না?" সাগরিকার বোন দীপিকা কাঁদতে কাঁদতে বলেন ,"দিদির স্বপ্ন ছিল মেয়েকে পড়ানো। নিজে তো ক্লাস সিক্সের  পরে আর পড়তে পারেনি। স্বামী হারিয়ে যাওয়ার পরে নয়নের মনি ছিল ওই মেয়েই। সে-ও হারিয়ে গেল। বাবার মতোই!"

সাগরিকার যুদ্ধ জটিল আবর্তে ঘুরপাক খেয়েছে আজীবন। বাবার একটি হাত ছিল না। সাগরিকা ও দীপিকা দুই মেয়েকেই খুব কষ্টে মানুষ করেছেন। বিপদের দিনে  মাথায় হাত রাখার কেউ ছিল না।  পুরো জীবনটাই লড়াই করে চলা। আজকের কর্মবিরতির যন্ত্রণা সয়ে নিচ্ছে সাগরিকা। কিন্তু মেয়ে হারানোর শোক কী করে ভুলে থাকা যায়! তাই উধাও হয়ে যাওয়া মেয়ের অপেক্ষার প্রহর গোনে যন্ত্রণা। বিরামহীন পদচারণায় ক্লান্তি নেই। সদর থেকে ঘরের কাছের থানায় গিয়ে প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থাকা। হাজার না শুনেও থামে না সাগরিকা। মেয়ের প্রত্যাবর্তনের বিশ্বাস নিয়ে প্রতিদিন আঁচলের পয়সা বেঁধে রিক্সা ঘোরায় থানার দিকে। দাঁড়িয়ে শুধু দাঁড়িয়ে কাটিয়ে দেয় ঘন্টার পর ঘণ্টা। 

তথ্য ও সমীক্ষা জানাচ্ছে, এই দেশে গড়ে প্রতিদিন হারিয়ে যান ২৭০ জন মহিলা ও শিশু। কিন্তু তাদের মধ্যে তো কেউ কেউ ফিরেও আসে!পুলিশ নয়, প্রশাসন নয়, বৃথা আশা মরতে মরতেও মরে না জেনেই সেই আশাতে বুক বাঁধছেন সাগরিকা! লকডাউন শেষ হলে হয়ত মেয়ে নিজেই এসে দরজায় কড়া নাড়বে!  মেয়ে নিয়ে সব অপমান ,অসম্মান আর অসহায়ত্বের দিন একদিন শেষ হয়ে যাবে।
হরিগঞ্জ,রেজিনগর,মুর্শিদাবাদ

Friday 8 May 2020

সিনিয়ারার তালাবন্দি জীবন

সিনিয়ারার লকডাউন যাপন


মেয়ের স্কুলের মিড ডে মিলের চাল-আলু দিয়ে চলেছে বিশ্বাস পরিবার কিছুদিন। সিনিয়ারার অভাবের সংসারের এ এক চরম বাস্তব। সিনিয়ারা বিড়ি বাঁধে। সংসারের পুরো ভার এখন তার উপর। স্বামী আকবর বিশ্বাসের শিরার অসুখ। রাজমিস্ত্রীর কাজ করত। দুই বছর ধরে বাড়িতে বসে। চেষ্টা করেও লাভ হয়নি। কুর্নি ধরলেই হাত কাঁপে। অগত্যা বেকার হয়ে যাওয়া স্বামী এখন ঘরেই। স্বামী ও দুই মেয়ে নিয়ে ঘর চালাতে সিনিয়ারা জেরবার। মেয়েরাই লকড়ি,পাতা কুড়িয়ে আনে। তাই দিয়েই ঘরের উঠানে মাটির আখা জ্বলে। ভাত কি আর শুধু খাওয়া যায়? আলু তো শেষ হয়ে গেছে কবেই! স্কুল ছুটি তাই মাঝে বেরিয়ে পড়ে দুই মেয়ে শাক-পাতা জোগাড় করতে। গ্রামের মানুষের কাছে লাজনা, পেঁপে চেয়ে আনছে মেয়েরা। তাতেই খাওয়া চলে যাচ্ছে।
লকডাউনের সময় রেশন থেকে ঘরে চাল এসেছে। কিন্তু রান্না করার জ্বালানী নেই। বিড়ি বন্ধ থাকায় সিনিয়ারা আর্থিকভাবে বেকায়দায় পড়েছে। স্বামীর চিকিৎসা বন্ধ হয়েছে। একসময়ে স্বচ্ছল ছিল বাড়ি। কাজ ছিল স্বামীর। উপার্জনও ছিল। সুখের সংসারে হঠাৎ অভাবের কালো ছায়া। সঙ্গে লকডাউন। সিনিয়ারা বলে, "অভাব এসে পড়েছিল আগেই কিন্তু লকডাউনে একদম গরীব হয়ে গেলাম। বিড়ির ইনকামটাই চলে গেল। খাবো কি?"
বছর পচিশের সিনিয়ারার বাল্য বিবাহ। পদ্মাপাড়ে বাপ -মায়ের বাড়ি ভেসে গেছে কবেই। দাম্পত্য প্রায় একযুগ পেরিয়েছে। বিয়ের আগেই বিড়ি বাঁধা শুরু। বিয়ের সময় স্বামীর অবস্থা খারাপ ছিল না। তাই স্বামীর ঘরে এসে বিড়িতে হাত দেয়নি। স্বামী অসুখে পড়ার পর সিনিয়ারা কাজে হাত দেয় নতুন করে। দুই মেয়ের মুখ চেয়ে শুরু করে বিড়ি বাঁধা। বিড়ির উপরেই সংসার ধীরে ধীরে নির্ভর হয়ে পড়ে। লকডাউনে হাত খালি হয়ে গেছে একেবারে। এখন বিকল্প কিছু খুঁজে পাচ্ছে না সিনিয়ারা। রোজা-নামাজ আর আল্লাকে ডাকাই একমাত্র ভরসা সিনিয়ারার। আফশোস করে বলে, "লেখাপড়া বাপ- মায়ে শিখায়নি। কলম এর বদলে হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল বিড়ির গজাল। বই এর বদলে বিড়ির কুলাকেই চিনেছিলাম। আমি সেই এক ভুল করবো না আর। মেয়েদের পড়াশুনা শিখিয়ে বড় অফিসার করব।" সিনিয়ারারা মেয়েদের জন্য ভরপুর স্বপ্ন দেখে। তারপর একদিন এই মেয়েরাই পরের প্রজন্মের অন্য সিনিয়ারা হয়ে ওঠে। কম বয়সেই সংসারের জোয়াল ঘাড়ে তুলে নেয়! হেঁশেলের অভাবের সঙ্গে লড়তে লড়তে ক্ষয়ে যায়! প্রতিদিন ছেলে-মেয়েদের মুখে দুমুঠো খাবার তুলে দেওয়ার চ্যালেঞ্জের সামনে জীবনের বাকি সব অর্থহীন হয়ে যায়। দস্তামারা,মুর্শিদাবাদ



সেলাই স্কুলের দিদিমনি চেনবানুর লাকডাউন যাপন

 চেনবানুর লকডাউনের দিন

দারিদ্র মেয়েদের কাজের মুখে ঠেলে দেয়। নিজের ভাত জোটাতে কাজে হাত লাগাতে হয়। চতুর্থ শ্রেণি পড়া চেনবানুকে বিড়ির কুলা থেকে তুলে এনেছিলেন উদ্যমী দুই মহিলা। অভাবের সংসারে পড়া বন্ধ হওয়ার আগেউ চেনবানুর কপাল খুলেছিল। ধীরে ধীরে চেবনাবু মাধ্যমিক পাশ করে। তার আগে থেকেই চলতে থাকে সেলাই ট্রেনিং। চেনবানুর স্বপ্ন ছিল সেলাই স্কুল খুলে মেয়েদের সাহায্য করা। সেই লক্ষ্যপূরণে সাহায্য মিলে যায় চেনবানুর। মেয়েদের উলের ও অন্যান্য কাজে চেনবানু খুঁজে পায় জীবনের নতুন মানে। এদিকে পড়াও জারি থাকে। আসে অন্য অধ্যায়। বিয়ের পর চেনবানুর জীবনে দ্বিতীয় অধায় আসে। রাজনীতিতে যুক্ত হয় চেনবানু। পাঁচ বছরের জন্য এলাকার চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়। তখন বাড়িতেই চালাতে থাকে সেলাই স্কুল। 

রাজনীতির পাট চুকিয়ে আবার ফিরে আসা নিজের কাজে। সেলাই স্কুল ও নিজের বাড়ী মিলে ১৩০ জন ছাত্রী চেনবানুর। নিজের জীবনের ফেলে আসা অতীত থেকে দরিদ্র মেয়েদের খুঁজে পেতে তাদের সেলাই শেখাতে থাকে চেনবানু। এবারে বাধ সাধে লকডাউন। দীর্ঘ সময়ের জন্য বন্ধ থাকে সেলাই স্কুল। মেয়েরা কিছুতেই লকডাউনে সাহস করে স্কুলে আসে না। স্যানিটাইজার ও মাস্ক দিয়েও উৎসাহ ফেরে না মেয়েদের। প্রাথমিকভাবে ৩জন আসতে রাজি হলেও দুদিন পরে  তারা বন্ধ করে দেয়।

কুড়ি বছরের মধ্যে এমন অভিজ্ঞতা হয়নি চেনবানুর। মেয়েদের কাজ শেখা মানেই তার উপার্জনের পথ তৈরি করা। আর উপার্জন মানেই একটি পরিবারে বোঝা হওয়া থেকে রেহাই পাওয়া। অর্থাৎ বিয়েটা আটকানোর জন্য নিজেকে উপযুক্ত করা। চেনবানু সেই ভাবনা থেকেই আতঙ্কিত। এত সময় ধরে লকডাউন স্কুলের  মেয়েদের হতাশ করেছে। আবার কয়েকজনের বিয়েও হয়ে গেছে। 

চেনবানু অপেক্ষায়। পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হয়! 



Thursday 7 May 2020

বিড়ি শ্রমিক কালোনের তালাবন্দির দিন

কালোনের লকডাউন যাপন

কে জানত লকডাউনের সঙ্গে প্লাস্টিকের এমন গভীর সম্পর্ক! বৃষ্টি হলে মানুষ কি করে? ভিজে যাওয়া থেকে বাঁচতে ঘরে আশ্রয় নেয়। বাইরে ছাতা সঙ্গে নেয়। কালোনরা কি করে? বৃষ্টিতে নাগাড়ে ভেজে। অঝরে চোখের জলের সঙ্গে পাল্লা দেয় বৃষ্টির জলরাশি। দুই হাত তুলে কালোনরা অভিযোগ করে আল্লাহর কাছে- "ম্যাঘ-পানি দিলা তো গরীবের ছাদ কেন দিল্যা না!" কালোনের নেই মাথার ছাদ। নেই একটা ছাতাও। খোলা আকাশ ও নিজের মাথার মধ্যে শুধু পাতলা এক প্লাস্টিকের আড়াল। রাত-দিনের হঠাৎ বৃষ্টিতে প্লাস্টিকের প্যাকেট মাথায় দিয়ে অপেক্ষা। প্রতি বছর একশো টাকায় একটা প্লাষ্টিক কেনা হয়। সেটা ছিঁড়ে গেলে আবার খোলা আকাশ। এবারে সেই প্লাষ্টিক কিনতে বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করতে হবে জানা ছিল না কালনের। বৃষ্টির সঙ্গে অভাবের এই লুকোচুরি কালোনদের জীবনজুড়ে। এই অভাবের মধ্যে নতুন সঙ্গী লকডাউন। লকডাউনে ঘরে নিজেকে বন্দি করার নিরাপদ আশ্রয়টাও নেই। ভাইরাস এসে পড়লেও কঠিন,পালিয়ে যাওয়ার পরেও মুশকিল। কালোনের অবস্থা এখন জলের বাইরে মাছের মত। ছটপটিয়ে কষ্ট পাওয়ার দিন লাগাতার জারি।

সতেরো বছর বিড়ি বাঁধছে কালোন। বিবি থেকে বেওয়া হয়েছেন। এখন তো কালোন চোখেও কম দেখে। এতদিনের বিড়ি শ্রমিক কালোনের নেই কোনও বিশেষ সামাজিক সুবিধার স্বীকৃতি। বিড়ি শ্রমিক হিসেবে রেজিষ্ট্রেশনের বিষয়ে কিছুই জানতে পারেনি আজীবন। কেউ একটা চশমারও ব্যবস্থাও করেনি। কিন্তু নাগাড়ে  হাতের কাজ চলছেই। লকডাউনে বন্ধ বিড়িবাঁধা। হপ্তায় সাড়ে তিনশো টাকা উপার্জনের পথও বন্ধ। ছেলে মারা গেছে অনেক আগেই। বৌমা অন্যত্র সংসার বেঁধে নিয়েছে। নিজের মেয়েটাও দুই দিনের বাচ্চা রেখে পৃথিবী ছাড়ল। সেই নাতনিকে নিয়ে কালনের সফর। বয়স হয়েছে । স্বামীর ভিটেতে কয়েকটা কঞ্চি দিয়ে ছিল কাদার দেওয়াল। টালির ব্যবস্থা  করে কালন উঠতে পারেনি । জীবন ফুরিয়ে গেল। মাথার উপরে ছাদের স্বপ্নপূরন হল না। এখন তো আবার পেটে টান। নাতনি ও নিজের খাবারের জন্য রেশন ও বিড়ির উপার্জন ছাড়া কিছুই ছিল না।

        
শাড়ির ছেঁড়া আঁচল ঘুরিয়ে মাথার উলটো দিকে টেনে নেয় কালোন । ভাঙা গলায় বলে, "লোক আসে। অভাব নিয়ে জিজ্ঞাসা করে,চলে যায়। গরীবের কেউ নেই। র‍্যাশন টুকুই ভরসা।"  কালোনের বুক জুড়ে কষ্ট আছে, অভিমানও আছে। রোজার সময় এখন ভোরে শুধু ভাত আর লংকা। ইফতারে নুন ভাত দিয়েই চলছে। মসজিদ থেকে মাঝে মাঝে ইফতার আসছে। নাতনির জন্য সেটা তুলে রাখে  কালোন। অভাবের দিনে নাতনিকেও বিড়ি বাঁধতে শেখায় কালন। দুজনে মিলে সংসারের হাল ধরে শক্ত করে। চেয়ে খাওয়ার চেয়ে নিজের উপার্জনেই ভরসা কালোনের। এভাবে যে সব বন্ধ হয়ে যাবে কে জানত! 
কত বয়সে বিয়ে মনেই নেই কালোনের। স্বামীর অসুখ ও মৃত্যুর পর অনেক রাত কেটেছে কালোনের। একাই সেসব  নিজের  হাতে মোকাবিলা করেছে। তিন দফার লকডাউউনে কালোন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। দিনের শেষ কিছুতেই হচ্ছে না কালোনের। মাথায় হাত দিয়ে বলে, খোদা বাঁচিয়ে নিলেন, রোজা না আসলে ভুখা পেটে এমনিই থাকতে হত  এই ক' টা দিন।"

রাজ্যে এগারো লাখের বেশি মহিলা বিড়ি শ্রমিকের একজন কালোন।  বিড়িতে নিয়োজিত কর্মীসংখ্যার নব্বুই শতাংশ মহিলা- শিশুদের একজন। একযুগের বেশি বিড়ি শ্রমিক হিসেবে কিছু পয়সা খেয়ে পড়ে কালোনের হাতে থাকার কথা! সেটা দিয়ে লকডাউনের অভাব সামাল দেওয়া যেতেই পারত। এর মূল কারণ বিড়ির সঠিক মজুরি না পাওয়া। বাতিল হয়ে যাওয়া বিড়ির দাম ও  প্রাপ্য মজুরির হিসেবে বোঝপাড়া হয়ে যাওয়া। সেখানে কালনের কিছু করার নেই। শ্রমের সমান মজুরি দাবির অধিকারও নেই। কালোনদের গোটা একটা  জীবন পেরিয়ে গেল। আজও সুরাহা হয়নি শ্রমের মর্য্যাদার। অসময়ে নিজের পেট চালানোর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা থাকলে এভাবে কালনকে হাহাকার করতে হত না। ছেঁড়া শাড়ির দৈন্যতা না ঢাকতে পারলেও নুন-ভাতের কোথায় চোখ ভরে আসত না। লকডাউন তার কাছে দূর্ভিক্ষের মত চেহারা নিয়ে হাজির হতে পারত না।   
   

Wednesday 6 May 2020

অভিবাসী মহিলা শ্রমিকের লকডাউনের দিন

অভিবাসী  মহিলা শ্রমিকের তালাবন্দি জীবন



পাঞ্জাবের গ্যাসপুরায়,বিজলী দপ্তরের তিন নম্বর গলি। লকডাউনে আটকে পড়েছেন একদল মহিলা শ্রমিক।  নিজের ঘর হরিহরপাড়া,মুর্শিদাবাদ থেকে ১৮০০ কিলোমিটার দূরে বসে এদের কান্না থামছেনা। কাছের ষ্টেশন লুধিয়ানা। মাথাপিছু ট্রেনভাড়া নাকি  ৭৫০ টাকা। ওদের কাছে ভাড়া নেই।  ফিরিয়ে  ঘরে নিয়ে আনার কেউ নেই। মহিলারা কেউ  ফেলে এসেছে বাচ্চা বাড়িতে। কেউ নিয়েছে সঙ্গে। বছর দুই  এর  সরফরাজ কেঁদেই চলেছে। খাবার বন্ধ হয়েছে চার দিন। দিনে ষাটবার করে হেল্পলাইনে ফোন করছে ওদের স্বামীরা। কিন্তু কোনও সাড়া নেই। সরকারী লাইন  থেকে নাকি বলেছিল যে রেশনের ব্যবস্থা করা হবে। সেটাও করা হয়নি। এখন রোজা করছে এক টুকরো বিস্কুট খেয়ে।

জরিনারা কেউ টায়ার বানানোর সহায়কের কাজ করে। কেউ ফ্ল্যাটবাড়িতে। কেউ করে দেহারি কাজ। দিনে কেউ  দুশো টাকা মজুরি পেত । কেউ বা একশো টাকা। ইদের আগে হিসেব করে টাকা নেবে এমনটাই ছিল পরিকল্পনা। কিন্তু লকডাউন হওয়ায় টাকাও মেলেনি। এখন তো ফেরার ভরসাও ক্ষীণ হয়ে আসছে। হাত ফাঁকা। সঙ্গে আছেন স্বামীও।  মেয়ে ৩২জন। পুরুষ ৯৮ জন। সবমিলিয়ে মোট ১৩০ জন। ঠিক পাঁচ মিনিট এগিয়ে মহিলা-পুরুষ মিলে আরও ১২০জন।  আটকে পড়ে সবাই অসহায়। ফিরতে না পেরে আশঙ্কিত।




রিম্পা বিবির বাচ্চারা পাঁচ  ও আট বছরের। গ্রামের  বাড়িতে পড়ে আছে। রিম্পা কাজে এসেছে দুই বছর। টায়ার বানাতে সহায়কের কাজ করতেন পাঞ্জাবে। ইদে বাড়ি আসার কথা ছিল। বাচ্চারা নতুন জামার জন্য বায়না করছে। রিম্পা বিবি ফোন ধরে অঝরে কঁদেই  চলেছে। বলছেন, " বিষ দিন আপনারা, খ্যায়ে মরে যাই!"

জরিনা বিবি গেছে লকডাউনের দুই মাস আগে কিছু রোজগারের আশায়। নাট বোল্টুর  কাজ করতেন। মাসে তিন  হাজার টাকাও পেয়েছেন।  লকডাউনের জন্য বাকি টাকা আদায় হল না। তবুও ঘরে বসে বসে একদিনের খাবার জুটত। শুধু রুটি। সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে।

সবনম বিবির বয়স কুড়ি। দুই বছরের বাচ্চা নিয়ে জেরবার। স্বামীর হাত ধরে কাজে আসা। ঘরের বিস্কুটও এখন  শেষ। বাইরে যাওয়ার উপায় নেই। গেটে সিকিউরিটি।

মমিনা বিবির দুই বাচ্চা বাড়িতে পড়ে। নয় বছর ধরে কাজ করছেন বাইরে। ফ্ল্যাটবাড়িতে কাজ করেন। সাত হাজার টাকাও পেয়েছিলেন  আগের মাসে। গত দুই মাসের  টাকা পেলেন না। কোনও টাকাও দিতে পারেননি বাড়িতে। আক্ষেপের শেষ নেই।  বাচ্চারা ইদের জামার অপেক্ষায়। ওরা পরব চেনে।  মমিনা আকুতি করে বলছে, "ও দিদি !একটু নিয়ে চলেন না,বাচ্চাদের দিকে মুখ তুলে একবার দেখুন আপনারা। ওরা তো মায়ের জন্য কেঁদে কেঁদে মরছে।"

পারভিনা বিবির দুই বাচ্চা। পাঁচ ও আট বছরের ছেলে। তিনিও কাজ করছেন প্রায় তিন বছর। ফোনে কাঁদতে কাঁদতে বলেছেন, "আমাদের বাড়ি ফিরিয়ে দেওয়ার কেউ নেই গো! ট্রেনের টিকিট কাটার পয়সা নেই। বাড়ি গেলে আপনাদের টাকাটা যেমন করে হোক শোধ করে দেবো। এবারের মত পার করে দিন।"

সবচেয়ে মুশকিল হল এই মহিলা শ্রমিকদের হাড়ভাঙা খাটুনির কোথাও হিসেব নিকেশ নেই। ওরা শুধু  শ্রমিকের বৌ ও শ্রমিকের বাচ্চার মা। ওদের জন্য আলাদা করে কিছু ভাবাই হয় নি। ঘর ছেড়ে,বাচ্চা ছেড়ে মাটি কামড়ে পড়ে রয়েছে ওরা। নিজেস্ব কোনও ইচ্ছা নেই,স্বাধীনতাও নেই। এমন কি অসংগঠিত শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতিটুকুও নেই!


হরিহরপাড়া,মুর্শিদাবাদ

Tuesday 5 May 2020

আশা কর্মী শান্তি লতার লকডাউন যাপন

 শান্তিলতার লকডাউনের দিন

অতিমারি যখন ঘরে আটকে রেখেছে মানুষদের,তখন আশালতারা গ্রামে গ্রামে মানুষদের সচেতন করার কাজ চালিয়েছে। গ্রামের অধিকাংশ মহিলাই হাত ধোয়া ও স্যানিটাইজ করার ব্যাপারে খুব বেশি আগ্রহী ছিল না। আবার অতিমারি নিয়েও খুব উদ্বিগ্ন ছিল না। ওদের বিশ্বাস ছিল অসুখটি শুধু বাইরে কাজে যাওয়া মানুষদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। শান্তিলতাদের প্রতিদিন নিয়ম করে গ্রামে গিয়ে বার বার বলার পরই সচেতন হয় সেখানকার মেয়েরা।  গ্রামের ভেতরে জল কাদা ভেঙ্গে যেতে গিয়ে শান্তিলতা নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। তবুও কাজ চলতেই থাকে।

শান্তিলতার প্রতি মুহুর্তেই চ্যালেঞ্জ। জীবনের শুরুটাও কি এত ক্লান্তিকর হয়! শান্তিলতা পৃথিবীর আলো দেখার পরই হারায় মাকে। তারপর চলে যায় বাবা। দাদুর কাছে থেকেই বেড়ে ওঠে ছোট্ট শান্তিলতা। মাধ্যমিক পাশের পর দাদুর মৃত্যুতে বন্ধ হয়ে যায় শান্তিলতার পড়া। বসে না থেকে ফার্স্ট এইড ও ব্রতচারীর ট্রেনিং নেয়। সেই সুবাদে আদিবাসী নৃত্যদলের কাছাকাছি আসে শান্তিলতা। তারপর দেশের নানা জায়গায় আদিবাসী নৃত্যদলের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায় শান্তিলতা। অনুষ্ঠান পিছু দলে আসে চার হাজার টাকা। এভাবেই একের পর এক কাজের সূযোগ আসে শান্তিলতার। নানারকম সার্ভের কাজেও যুক্ত হয়। পয়সার জন্য সবরকমের কাজের সন্ধানে লেগে থাকে শান্তিলতা। 

অতিমারির দিন ছিল খুব কঠিন। প্রতিদিন প্রত্যন্ত গ্রামে যাওয়া। নিরাপদ থাকার নিয়মাবলী প্রচার করা। সর্দি জ্বরে ডাক্তারের কাজে যাওয়ার  পরামর্শ দেওয়া। দরকারি ওষুধ বলে দেওয়া। তারপর ফিরে এসে সংসারের দায়িত্ব পালন। আবার  ডাক পড়লে বিকেল বেলায় অন্য একটি গ্রামে যাওয়া। সমস্যা ছিল নিজেকে সংক্রমণ থেকে মুক্ত করা। অন্যদিকে পরিবারের মানুষদের সুস্থ রাখা। অবশেষে কোরোনা যুদ্ধে জিতেই যায় শান্তিলতারা। এলাকাকে অতিমারির কবল থেকে মুক্ত রাখে। সচেতনতার পাঠে এখনও সংযমী এলাকার মানুষ।

নবগ্রাম,মুর্শিদাবাদ 

Monday 4 May 2020

কবিয়াল দুলালী চিত্রকরের লকডাউন

দুলালী চিত্রকরের লকডাউন যাপন
 লকডাউনের মধ্যেই করোনা নিয়ে অনেক গান লিখেছেন মহিলা কবিয়াল  দুলালী চিত্রকর । কিন্তু শোনার লোক কই! দুলালী বলেন,"আমরা কবিয়ালরা সমাজকে সচেতন করতে পারি কবিগানের মধ্যে দিয়ে! সরকার আমার মত এক মহিলা কবিয়ালকে কাজেই লাগালো না! গ্রামে গ্রামে  গিয়ে মাইকে  করোনা সচেতনতার গান করতে বললে আমি অবশ্যই যেতাম।  নিয়ম মেনেই যেতাম।পুলিশ লাঠি দিয়ে যা পারছেনা আমি গান গেয়ে তা করে দেখাতাম।"

তিরিশ বছরের কবিয়াল জীবন দুলালীর। ত্রিশ দিনও বসে থাকার অভিজ্ঞতা নেই। সরাসরি কলকাতায় ফোন করে  দিল খোদ  দপ্তরেই। জানতে চাইল শিল্পীদের বাঁচার কি উপায়! জবাব  এল "আমরা ভাতা দিয়েছি! আগে তো কেউ কিছুই দিত না আপনাদের!"  কবিগানের দাপুটে লোকশিল্পী দুলালী চিত্রকর লকডাউনে নিজেদের অবস্থার বর্ণনা করতে গিয়ে বেশ হতাশ । ফুরিয়ে আসছে রেশনে পাওয়া পাঁচ কেজি চাল। শিল্পীভাতার হাজার টাকা কবেই শেষ। মুখ লুকিয়ে ত্রান নিতে যাওয়ার সাহস নেই। এতবড় শিল্পী হাত পেতে  খাবার চাইতে এসেছে! এই লজ্জায় দুলালী বাড়ির কাউকে যেতে দেয়নি। দশ জনের সংসারে এবার মাস পেরিয়ে অভাব উঁকি দিচ্ছে। শেষ গান গাইতে যাওয়া  চৈত্র মাসে বর্ধমান গলসী পীড়পাড়ায়। তারপর বাইশটা গানের আসর একে একে আসর বাতিল হল। মোট ৭৫ হাজার টাকার ক্ষতি। আগাম বায়না নেওয়া গানের আসরের টাকাও ফিরিয়ে দিতে হবে। লকডাউনে সব অনুষ্ঠান বাতিল হয়েছে। দুলালী ঘরে বসে মানসিক পীড়ায় দিন কাটাচ্ছেন। 

  

পটুয়াদের পেট চলে গান গেয়ে ও  মূর্তিনির্মাণ করে। এখন পট দেখার লোক নেই। ঠাকুর কেনার মানুষ নেই।  লকডাউনে ঘরে বসে অনাহারের সঙ্গে লড়াই। আঠান্ন বছরের লড়াকু দুলালী ভেঙে পড়ে বলে, "এমন দিন কখনও আসবে ভাবিনি, পেটের ভাতের চিন্তা এভাবে করতে হবে!" জীবনে সব লড়াইয়ে দুলালী দাপটের সঙ্গে এগিয়েছে। এমনকি পৈতৃক সম্পত্তিও আট বছর ধরে উদ্ধার করেই ছেড়েছে! যদিও গর্ব করে জেলার বিখ্যাত মহিলা কবিয়াল দুলালী বলে, "সারা ভারতে সবচেয়ে সৎ এই চিত্রকরেরা। এদের বিরুদ্ধে কোনও মামলা নেই ইতিহাসে। খেটে খাওয়া জীবন চিত্রকরদের। আজ সেই সমাজটাই ভেঙে পড়েছে।" অভাব,অনটনের সঙ্গে  লড়াই জারি ছিল পটুয়াদের। এই লকডাউনে মনের জোর অনেকটাই  কমেছে দুলালীদের সঙ্গে থাকা পনেরোটি  মনসা মঙ্গল,বাউল,কবিগান শিল্পী পরিবারের।

করোনা নিয়ে অনেক গান লিখেছেন দুলালী। কিন্তু শোনার লোক কই! দুলালী বলে,"আমরা কবিয়ালরা সমাজকে সচেতন করতে পারি কবিগানের মধ্যে দিয়ে! সরকার আমার মত এক মহিলা কবিয়ালকে কাজেই লাগালো না! গ্রামে গ্রামে আমাকে মাইকে  করোনা সচেতনতার গান করতে বললে আমি যেতাম। পুলিশ লাঠি দিয়ে যা পারছেনা আমি গান গেয়ে তা করে দেখাতাম।"  

আত্মবিশ্বাসী দুলালী বলে, "বন্ধন থেকে লোনের টাকা নিতে আসছে দিদি!লুকিয়ে ঘরে বসে থাকি ! ভাবতে পারেন! গরু,ছাগল কিনেছিলাম লোন করে। সেগুলোই নিয়ে আর এক সংসার। ওদেরকেও দেখতে হয়! অভাবে এরাও ভুগছে আমাদের মতই!"
"শিল্পীদের সম্মান আদায় করে নিতে চলে গেল জীবনের সিংহভাগ। এবারে পেটের জন্য  নতুন লড়াই শুরু। লকডাউন আমাদের খুব সম্মানের মুখে ফেলে দিল। । পেটে খিদের আগুন কি আর ভাইরাসের সতর্কতা বোঝে বলুন !"- মাথার উপর সার দেওয়া পুরষ্কারের সামনে দাঁড়িয়ে আক্ষেপ করে বলেন দুলালী চিত্রকর। 
গণকর,মির্জাপুর,মুর্শিদাবাদ

         

Sunday 3 May 2020

সেলাই কর্মী টায়রার লকডাউন যাপন

ইনফরমাল সেক্টর ও অসংগঠিত লেবারদের অবস্থা সারা বিশ্বে সংকটজনক। ৪০০ মিলিয়ন কর্মী ঝুঁকির মুখে পড়েছে। ্প্রায় ৬০ শতাংশ মহিলা অসংগঠিত লেবার । হঠাৎ লকডাউনে বহু ট্রেনিং সেন্টারের বন্ধ হয়েছে ফান্ড। আটকে গেছে প্রোজেক্ট। পরিচালনার দায়িত্বে যারা ছিলেন তারা টাকাও পায়নি! এমন এক অবস্থার শিকার টায়রা খাতুন! প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে  প্রাপ্য টাকা মেলেনি। আবার ট্রেনিং সেন্টারও বন্ধ।বাড়িতে এক দম আটকানো  পরিবেশ।

টায়রার বোনের শ্বশুরবাড়ি থেকে ফেরৎ এসেছে বোন। গায়ের রঙ কালো। ওরা ভালো বৌ নেবে। লকডাউনের মধ্যেই সালিসি হওয়ার কথা! টায়রা নিজের উপার্জনের পয়সা দিয়ে দিয়েছিল বিয়ে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই ওদের আরও টাকা চায়। সেই অজুহাতেই উঠে এল- বৌ দেখতে ভালো নয়!স্বামী লেবার ও  অশিক্ষিত। তাই স্বামীর বাবা-মাই স্বামীর মন-মর্জির নিয়ন্ত্রক।


এদিকে টায়রা নিরুপায় হয়ে  ঘরে বসে সেলাই এর কাজ শুরু করেছে। অর্ডার খুব সামান্যই মিলছে! শহরে প্রশিক্ষণকেন্দ্রের কাজটাও বন্ধ। লকডাউন কবে উঠবে তার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে টায়রা। সংসার কোনভাবেই চলছে না। নতুন করে একটা ব্যবসার পরিকল্পনা নিয়েছিল টায়রা। সেটাও আপাতত লকডাউনে  বন্ধ। সেলাই এর কাজ চললেও ডিলিভারি নেওয়ার লোক নেই। হাতে নেই পয়সা! পরিবারের চারজন মানুষ চালিয়ে নিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব টায়রার পক্ষে। সেই মেয়েরা যারা পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম, লকডাউন তাদের বিপদের মুখে ফেলেছে! একদিকে বাড়ি ছেড়ে বাইরে আসার উপায় নেই। অন্যদিকে ঘরে বসে উপার্জনের পথ নেই। রেশন থেকে পর্যাপ্ত চাল মিললেও থাকে নানা খরচ। সেগুলির জন্য  হাতে ক্যাশ পয়সা  প্রয়োজন। এই পরিস্থতিতে লড়াই করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে। এখন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলার অপেক্ষা! কাজ চালিয়ে যাওয়ার আশ্বাসের অপেক্ষা।

হরিহরপাড়া,মুর্শিদাবাদ

        

Friday 1 May 2020

মুসলিম বিয়ের গানের শিল্পী মদিনার লকডাউন

মদিনার লকডাউন সফর 


বদলে গেল সব এক ঝটাকায়! কে জানত লকডাউনের জেরে  নিজের সংসারটাই তুলে নিয়ে আসতে হবে বাপের বাড়ি। মুসলিম বিয়ের গানের শিল্পী  মদিনার স্বামী  আজফার সেখ সৌদিতে আটকে। কাজ আছে কি নেই তাও জানে না আজফার। বাড়িতে পাঠানোর জন্য জমানো টাকাটুকুই বিদেশে সম্বল।  শেষ হয়ে গেলে কি হবে জানা নেই। একটা ঘরে আজফারদের রেখে কোম্পানি তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে। খাবার দিতে লোক আসছে। কখনও দিনে একবারও দেখা নেই। কখনও দুই দিন। স্বামীর কাছে এমন অশান্তির কথা শুনে ভেঙে পড়ে মদিনা। এদিকে অভাবের মধ্যে  শ্বশুর বাড়িতে ছেলে নিয়ে পড়ে থাকতে পারল না মদিনা। তার উপর রোজা শুরু হয়ে গেল। স্বামীও টাকা পাঠাতে পারেনি সংসারে। খরচের বোঝা শ্বশুরবাড়িতে  না বাড়িয়ে  শেষমেশ বাপের বাড়ি ফেরে মদিনা। বাপের বাড়ির হালও ভাল না। বৃষ্টিতে ধানের ক্ষতি হয়েছে । দিন মজুরের  দাম বেড়ে যাওয়ায় ধান কাটা নিয়েও বিড়ম্বনা। মদিনা খুব অসহায় হয়ে বলে, "লকডাউনের জন্য শ্বশুরবাড়ি থেকে পালিয়ে এলাম। এখানেও স্বস্তি নেই। কি যে করি ছেলে নিয়ে!  

মদিনা মুসলিম বিয়ের গান করে। কাজের প্রয়োজনে নানা জায়গায় যাওয়া। গতবার যাদবপুর ঘুরে এসেছে।  আগের মত এখন আর মুসলিম বিয়ের গানের চর্চা নেই। অনুষ্ঠানও বেশি হয় না। এখন বছরে  দুইবার বাইরে যাওয়ার ডাক পায়। বাকি সময় পলিথিন ও পাথরের ব্যাগ ও ফুলদানি তৈরি করে মদিনা। এখন বেকার বাড়িতে বসে। লকডাউনে পাথর,পলিথিন কিছুই পাওয়া যায়নি। হাতে কাজ নেই। আবার  স্বামীর চিন্তা। অন্যদিকে ছেলে রিয়াজের পড়াশুনা নিয়ে উদ্বিগ্ন। স্কুল বন্ধ। বই-খাতা সব তোলা। পড়তে বসালেই ছেলের খাওয়ার বায়না। নইলে ফোনে আব্বার সঙ্গে কথা বলার আবদার। মদিনা এসব নিয়ে জেরবার। ইদে একসঙ্গে তিনমাসের টাকা নিয়ে আসবে। কথা হয়েছিল রিয়াজের আব্বার সঙ্গে এমনটাই। তাই হাত টান ছিলই। কিন্তু লকডাউনের ফলে পয়সার অভাব মদিনাকে একদম অপ্রস্তুত করে দিয়েছে। খুব আড়ষ্ঠ হয়ে মদিনা বলে,"কাকে কি বলবো! চোখের জলে বালিশ ভিজে যাচ্ছে। রাতে ঘুম আসেনা। ছোট্ট সংসারে অভাব ছিলট, কিন্তু শান্তিও ছিল। এখন শান্তি কবে ফিরবে জানিনা।"  
   
                                              
                                                       
মদিনার  মাত্র তেরো বছরেই বিয়ে। চাষবাস করে সংসার কোনোরকমে চললেও অভাব মেটে না। সংসারের হাল ফেরাতে না পেরে স্বামী শেষমেশ গ্রাম ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। মদিনা আগেই  যুক্ত হয় বিয়ের গান ও হস্ত শিল্পে। হাতে কিছু পয়সা না থাকলে ছেলেকে নিয়ে চালিয়ে যাওয়া কঠিন। এই ভেবেই মদিনার কাজে হাত দেওয়া। লকডাউন সেই সফরে এক অনিশ্চয়তা এনে দিয়েছে। মদিনা বলে, "মানুষের আর কি করার ক্ষমতা আছে! নতুন অসুখ। আল্লার কাছে তাই মোনাজাত করছি যে, স্বামীর মুখের আহার যেন কেড়ে না নেয় । ছেলেটার পড়াশুনাটা যেন ঠিকঠাক হয়।"

মদিনার কাছে লকডাউন নিয়ে যত অনিশ্চতা তার চেয়ে অনেক বেশী কষ্ট হাতে কাজ না থাকায়। এতদিনের অভ্যাস। দুপুরে হাত খালি থাকে না কখনও। মদিনা বলে, "কিছু না হলে দলবেঁধে  বিয়ের গানটাও বসে বসে করি। এখন তো দলের অন্য মেয়েরা  আসতেও পারছেনা। ভালোবেসে কাজটা করি তো! নিজের অভাবের কথা বলিনা, ওদেরটা শুনলে মন খারাপ হয়ে যায়! কাজের সরঞ্জাম নেই,গানের ডাকও নেই।" মদিনার  অভাব চেনা। হেঁশেল ঘরে ভাতের হাঁড়িতে চাল না ফুটাতে পারার দিনও দেখা।  অন্যমনস্ক হয়ে বলে, "ভাবছি ছেলের কাছে পড়াটা শিখব। পারব তো দিদি শিখতে? স্বামী মেসেজ পাঠায় মোবাইলে। পড়তে পারিনা। ভাবছি শিখে রাখি যদি কাজে লাগে। যদি কোনও কাজ পাই!"

এমন সরল ও সুন্দর মানুষগুলো কি অসহায় হয়ে পড়েছে আজ! এই দেশের প্রতি গলি,প্রতি মহল্লায় মদিনারা ভিড় করে আছে। এদের কাহিনী বহুদিন ধরে জানা। এদের হাতের রেখা ও ললাট লিখন কেউ বদলানোর কথা ভাবে না । কেননা এত লোকের অভাব কি বদলের? শুধু একজন মদিনার হাত যদি কেউ শক্ত করে ধরত তবে এরা পাহাড় ভেঙে দেখাতে পারত!  প্রায় বছর পয়ত্রিশের মদিনা স্বপ্ন দেখে তার ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া ছেলের কাছে লেখাপড়া শিখে লকডাউনের পর সে একটা কাজ পেতেও পারে!  বিয়ের গান ও হাতের কাজের ফাঁকের দিনকটা  বসে না থেকে কাজ করবে। এই স্বপ্ন দেখার চোখকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয় বার বার। কত লক্ষ -কোটি লোক জগত জুড়ে বেকার হচ্ছে মদিনা জানে না ,জানতে চায়ও না। ওঁর জগতে ও নিজেকে বেকার ও  ঘরে বসা রান্না করা মেয়ে ও মা হিসেবে কখনও দেখতে চায়নি। আজও চায় না। লকডাউন পায়ে বেড়ী পরিয়েছে ঠিকই। কিন্তু মদিনা থেমে থাকার দলে নয়।              
দুর্গাপুর, জীবন্তি, ভরতপুর-২,মুর্শিদাবাদ

কাথাষ্টিচ শিল্পী সোনালির লকডাউনের দিন

  কাঁথাষ্টিচ শিল্পী সোনালির লকডাউন যাপন    মেয়েদের সুন্দর মুখের নয়, সুন্দর কাজের জয়  সর্বত্র। সাফল্যের সীমানা দিগন্তপার। তাইতো সোনালীদের এত ...