Wednesday 4 November 2020

কাঁথাষ্টিচ শিল্পীর বিলকিসের লকডাউন যাপন

বিলকিসের লকডাউনের দিন 

 আমাদের লক্ষ্মীরা ছড়িয়ে আছে উঠোন -দেওয়াল-ছাদ জুড়ে। কখনও বিলকিস,কখনও সোনালি কখনও মীরা নাম নিয়ে। মস্ত আকাশের নীচে এদের একার সংগ্রাম। সাত বছর বয়স থেকে সেলাই জানা বিলকিসের নিজের সেলাই প্রতিষ্ঠান ৩০ বছর পার করেছে। ফিরে দেখা ঝাপসা চোখে শুধুই মিরাকেলের ছড়াছড়ি। মেয়েদের নিয়ে কিছু করার ইচ্ছা আর আবেগ প্রায় সব ট্রফি জিতে এসে হাতে ধরিয়েছে বিলকিসের। একদম শুরুতেই প্রায় ১১ রকমের কাঁথা ষ্টিচের নাম ও সেলাই দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দেয় তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের এক অনুষ্ঠানে বিলকিস সকলকে। নিজের নামও তুলে দেয় জেলা তথ্যের ইতিহাসে। সেই সময় ১৫ হাজার টাকায় বিক্রী হয় ইতিহাসের পাতায় খুঁজে পাওয়া নানাধরণের কাঁথা স্টিচ দিয়ে তৈরি বিলকিসের শাড়ি। কিন্তু কোভিডকাল বিলকিসকে ধরাশায়ী করেছে বেশ।

রাজারহাট থেকে প্রায় ১৫ লক্ষ টাকার ষ্টিচের শাড়ি-চাদর ও পোশাক নিয়ে গাড়ি করে ঘরে ফেরা। মাত্র ৭০ হাজার টাকার বিক্রী হতেই লকডাউনের ঘোষণায় মেলা গুটিয়ে ফিরতে হয় বিলকিসকে। তবু দুশো মেয়ের সংসারের দায় মাথায় নিয়ে বিলকিসরা ধরিত্রীর লক্ষ্মীদের বুকে আগলে রেখেছে। এদের বাঁচিয়ে রাখার আরাধনায় বিলকিসরা মগ্ন। কুড়ি বছর আগে স্বামীর হঠাৎ মৃত্যুর সাতদিনের মধ্যেই মেলা যায় বিলকিস মেয়েদের নিয়ে। শোক-দুঃখ জয় করে ছোটে কর্মযজ্ঞের রথ।

উত্তরণের সূর্য প্রায় দুই যুগেরও আগে উঠেছিল। স্বামীর সঙ্গে লোন নিতে ব্যাংকে আসা বিলকিসের। সবেমাত্র কয়েক ইঞ্চি বোনা হয়েছে সোয়েটার। ব্যাংকে ভিড় দেখে চেয়ারে বসেই সোয়েটার বুনতে থাকে বিলকিস। বেলাশেষে ডাক পড়ে বিলকিসের। তখন সোয়াটারের একটা পার্ট শেষ হতে চলেছে। ম্যানেজার বিলকিসের একনিষ্ঠতা ও ধৈর্য দেখে পরামর্শ দেয় একটা সেলাই মেশিন কিনে উলের কাজ করার। ফিরতি পথে ট্রেনের কামরায় সাঁটানো এক পোষ্টার নজরে আসে। সেখানে ছিল কাটোয়ার উলের মেশিনে সোয়েটার বোনার ঠিকানা ও ফোন নাম্বার। তারপর আর পেছন ফিরে তাকানো নেই। বাজারে রেডিমেট উলের সোয়েটারের তখন খুব বেশি চল না থাকায় বিলকিসের বাড়িতে ভিড় জমায় প্রশাসনিক মানুষ থেকে ডাক্তার,অধ্যাপক,শিক্ষকরা। উলের সঙ্গে শুরু হয়ে যায় শাড়ি, চাদর ও কাঁথায় গুজরাটি,আড়ি, ব্লক,বাটিকসহ নানাধরনের ষ্টিচের কাজ। ভাগ্য খুলে যায় তন্তুজ থেকে অর্ডার পেতেই। কুড়িটি মেয়ে নিয়ে কাঁথা ও সিল্কের থানে কাজ শুরু করে বিলকিস। তারপর একের পর এক বাড়তেই থাকে কাজ। গড়ে ওঠে নিজের নামে প্রতিষ্ঠান। এখন সেখানে ২০০টি মেয়ে করছে কাজ।


আনলকডাউন ফেজ-৫ কিছু আলাদা করতে পারেনি বিলকিসদের জন্য। বিক্রী একদম বন্ধ। মেলারও ডাক নেই। কিন্তু বিলকিস মেয়েদের কাজ চালু রাখতে বদ্ধপরিকর। নিজের জমানো টাকা দিয়ে স্টক করেছে থ্রি পিস,আর্টের জন্য থান,পালাজো সেট, দোপাট্টা। স্টিচের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে মেয়েরা। সংসারটা তো বাঁচাতে হবে! সিল্কের টুকরো দিয়ে তাপ্পির চাদরের কাজও চলছে। মঞ্জুষায় সাপ্লাই দেয় বিলকিস প্রতিবার। এবারে অর্ডারের খবর নেই কোনো। প্রায় সাত মাস লকডাউনে ঘরে বসে একে একে করা মেয়েদের কাজ নিয়ে খুব গর্বিত বিলকিস। সুতো ডিজাইন সব নিজেই দিয়েছে। মেয়েরা থেমে নেই। ভাইরাস দেহে বাসা বাঁধার হুমকি দেয়। কিন্তু বিলকিসের মেয়েরা কাজের হাত চালিয়ে যাওয়ার সাহস দেখায়! লকডাউনের মধ্যে করা মেয়েদের প্রতিটি কাজের দাম অবিশ্বাস্যভাবে কম রেখেছে বিলকিস। ব্যবসা করা নয়। প্যাশন বাঁচিয়ে রাখা হয়ত একেই বলে!

বিলকিস শুধু এই দুশো মেয়ে নিয়ে আটকে পড়তে চায় না। স্বপ্ন একটি সেলাই স্কুল খোলা। অনেক বেশি মেয়েদের কাজ শেখানো ও তাদের আত্মনির্ভর করা। ঘরের এই লক্ষ্মী-দূর্গাদের সকলে চিনল কই!


সালার,মুর্শিদাবাদ

No comments:

Post a Comment

কাথাষ্টিচ শিল্পী সোনালির লকডাউনের দিন

  কাঁথাষ্টিচ শিল্পী সোনালির লকডাউন যাপন    মেয়েদের সুন্দর মুখের নয়, সুন্দর কাজের জয়  সর্বত্র। সাফল্যের সীমানা দিগন্তপার। তাইতো সোনালীদের এত ...