Tuesday, 28 April 2020

দুই বিধবার লকডাউনের দিন

সামিলা ও লাইলির লকডাউন

লকডাউন শুধু সামাজিক দূরত্ব রক্ষার অগ্নিপরীক্ষা নয়। অসময়ে বন্ধুত্ব গড়ার দিশাও দেখাচ্ছে লকডাউন। সামিলা ও লাইলির ষাট পেরিয়ে গেছে। স্বামী নেই প্রায় দুই যুগ। একজনের বারো ,অন্যজনের তেরোতেই বিয়ে। চল্লিশ হতে না হতেই স্বামী মরে গেল। তারপরে প্রায় আঠারো- কুড়ি বছর ধরে লড়াই। স্বামীর ভিটে-মাটি আগলে একা। অভাবের দিনে  চলছে দুইজনের খুদ,রুটি বিনিময়। আঁচলে বেঁধে সামিলা নিয়ে আসছে খুদ ও আটার নাড়ু লাইলির জন্য। লাইলিও সামিলাকে দিচ্ছে পরের বাড়ী থেকে চেয়ে আনা ভাত-রুটি। লকডাউনের দিনে কেমন আছেন? জিজ্ঞাসা করতেই মাথা নীচু দুইজনের। ধরা গলায় বলে,"কাজ নাই ,পায়সাও নাই।" জীবনের নানা হারানোর দুঃখের সঙ্গে এখন কাজ হারানোর দুঃখ মিলেমিশে গেছে। বিড়ি বাঁধা বন্ধ হয়ে গিয়েছে অনেকদিন। ছেলেদের কাছে হাত পাততে মন চায় না ওদের। গর্ব করে বলছে, "ব্যাটারঘের কাছে হাত পাতি না। কাজ করেই খাই। বাতাসের অসুখটা চলে গেলে একটু হাড়ে হাওয়া লাগবে।"


      

সামিলাকে ব্যাটা খেতে দেয় না। মেয়ের বিয়ে দিয়েছিল। জামাই আবার বিয়ে করেছে। 'ছাড়ান' হয়ে গেছে। বিটি এখন বাড়িতে বসে। বছর চল্লিশ হয়ে গেল। বিড়ি বেঁধেই পেট চলে। সামিলা চোখ মুছে বলে,"আমার স্বামী মরে গেল। তাই একলাই কাটনু। বিটির বিহার পর স্বামী ছেড়ে দিল। ও একলা হল ফের। কপালের দোষ কি কেউ খন্ডাতে পারে?" 

লাইলির স্বামীর পরেই মারা গেল বাপ-ভাই এক এক করে। লাইলি স্বজন হারাতে হারাতে শেষমেশ একা হয়ে গেল। দুই ব্যাটা। মাঠে খাটে। মেয়ে জাহিরুন্নেশা তিরিশ পেরিয়েছে। আজন্ম মাথার অসুখ। পা-হাত নিয়ে পারেনা চলতে। কানেও ভালো শুনতে পায় না। এখন বাড়িতে চুলা জ্বলে না। সকালেই বেরিয়ে পড়ছে জাহিরুন্নেশা। ঘুরে ঘুরে  খাবার চেয়ে বেড়ায়। যেদিন আনে, ভাগ করেই খায়। নইলে জলটাও চায় না মায়ের কাছে।  লাইলি বলে,"মেয়েটা খেপি। খেতে দিতে পারিনা। ও লকডাউনে চেহে চিনতে যা আনছে তাই খেছে। আমি তো মুখ পানে সাহস করে  দেখিনা।" 

কোনও সাহায্য পেয়েছেন আপনারা? সামিলা মাটির ভাঙা জানালার দিকে তাকিয়ে বলে,"জীবন কেটে গেল আমাদের। কেউ কিছু তো দিলে না। এখন খেতে পেছি না। কেউ ভুলেও  জিজ্ঞাসা করে না।" লাইলি বলে, "হাঁড়িতে ভাত আছে কিনা, চুলা জ্বলছে কিনা কেউ ভুলেও হাঁক দেয় না একবার।"

দুই বিধবার এই বেঁধে বেঁধে থাকা জীবন লকডাউনকে যেন অন্য পথ দেখাচ্ছে । দূরত্ব  বলে কি সত্যিই কিছু হয়? অভাব যাদের স্বভাব নষ্ট করতে পারেনি সেই সামিলারা ঝরা পাতার মত উড়ে যাওয়ার সব সম্ভাবনাকে হার মানাচ্ছে। নিজের যা কিছু আছে তার আন্তরিক বিনিময় করে,বিলিয়ে দিয়ে বাঁচার নিত্যনতুন কৌশল রপ্ত করছে। 'চোখের পুতুল' নষ্ট হয়েছে সামিলার কিন্তু লাইলির মনের দৃষ্টি অনেকদূর দেখে আজও। বৈধব্য তো মনে লাগে! শরীর কি আর চিহ্ন বহন করে? ভাতার  কাগজে কি লেখা থাকে লাইলি -সামিলাদের সত্যিকারের অভাবের কথা! স্বামী মরার পরদিন থেকেই তো এদের জীবনজুড়ে লকডাউনের ছায়া।  আজকের লকডাউন উঠে গেলেও লাইলিদের সঙ্গে  সমাজের  'দো গজ  দূরি'র লক্ষ্মণ রেখা মেটায় কার সাধ্য!     

লালখানদিয়ার,জঙ্গীপুর, মুর্শিদাবাদ

No comments:

Post a Comment

কাথাষ্টিচ শিল্পী সোনালির লকডাউনের দিন

  কাঁথাষ্টিচ শিল্পী সোনালির লকডাউন যাপন    মেয়েদের সুন্দর মুখের নয়, সুন্দর কাজের জয়  সর্বত্র। সাফল্যের সীমানা দিগন্তপার। তাইতো সোনালীদের এত ...