Thursday, 9 April 2020

গামছা শিল্পী মীরার লকডাউনের দিন

গামছা বুননের কারিগর মীরা

প্রতিদিন চারটে করে গামছা। মীরা মণ্ডল নিজের হাতে তৈরি করে। সারাবছরের এটাই ধরাবাঁধা হিসেব। চলছে নাগাড়ে ১৮ বছর। লকডাউনের আগে ঘরে মজুত ছিল  মাত্র ২৪ টা গামছা। মহাজন ঘর থেকে নিয়ে গেছে।  অন্যসময়ে গামছা বিক্রি ৭০ থেকে ৮০ টাকায়। লকডাউনের জন্য কম দামেই ছাড়তে হয়েছে। সেই ২০০২ সাল থেকে গামছা বোনা শুরু মীরা মণ্ডলের। শ্বশুরবাড়িতে পা দিয়েই মীরা বুঝতে পারে অভাবের সংসার। মাধ্যমিক পাশ মীরা দেরি না করে পয়সার সন্ধানে গ্রামে বেরিয়ে পড়ে। ঘরে বসে কী করা যায় খুঁজতে গিয়ে দেখে গামছাটাই সহজ। গোষ্ঠীর টুকটাক কাজের বাইরে একটা নিজেস্ব কাজ না থাকলে সংসার চলবে না। এলাকা থেকে তেরো কিলোমিটার দূরে গ্রাম। ঘরের কাজ সেরে বাইরে গিয়ে কাজ করাও মুশকিল। তাই গ্রামেই গামছা বোনা দাঁড়িয়ে শিখতে থাকে মীরা। প্রায় তিনমাস দেখে দেখেই কাটে। সুতো ছিঁড়ে যাওয়ার ভয়ে কেউই হাত লাগাতে দিত না বুননে। মীরা মন ছোট না করে  অপেক্ষা করতে থাকে সময়ের। তারপর  নিজেই বাড়িতে শুরু করে কাজ। দুই রকমের সুতো দিয়ে গামছা বুনে হাতেখড়ি হয় মীরার। তারপর চার রকমের সুতো দিয়ে বোনে চেক গামছা। লম্বায় চার হাত ও চওড়ায় দুই হাতের গামছা বোনে প্রথম। স্বামী বাইরে রাজমিস্ত্রী খাটে । তাই সংসারের খরচ মীরাকেই যোগাতে হয়। মেয়ের পড়াশুনার দায়িত্বও তার উপরেই। লকডাউনের জন্য ঘুম ছুটেছে মীরার। কন্যাশ্রীর টাকা ও নিজের লোনের টাকায় মেয়েকে আইন নিয়ে পড়তে পাঠায়। এবার দ্বিতীয় সেমিষ্টার হবে। ফি বারো হাজার সাতশো টাকা। এই সময় মোবাইলে ম্যাসেজ দেখেই আঁতকে ওঠে মা-মেয়ে। ঘুম ছুটে যায় মীরার।

                                                              

প্রতিদিন ৮ থেকে ১০টি গামছা মহাজনের কাছে দিয়ে মিলত অগ্রিম একশো থেকে দু’শো টাকা। তা দিয়েই চলত দিনের খরচ। এখন সেটাও বন্ধ। এদিকে ঘরে চারটে মানুষ। লকডাউনের পর আবার  মহাজন বাড়াতে পারে সুতোর দাম। তাতেও কমবে লাভের হিসেব। বেশি টাকা কেটে নেবে মহাজন। ঘরের কাজ সেরে এত পরিশ্রমের পর যদি উপযুক্ত পারিশ্রমিক না মেলে তাতে খারাপ লাগার কথা। আবার অভাবের ভয়েও মীরা বেজায় অস্থির। লোন ঝুলছে মাথায় ২৫ হাজার টাকার। প্রতি মাসে শোধ দিতে হয় হাজার খানেকের কাছাকাছি। তিনমাস না দেওয়ার সুযোগ এলেও কাজ বন্ধ। পয়সা পাবে কোথায়? মেয়ের ল-পড়ার খরচ চালাবে কী করে? স্বামী লকডাউনের আগেই চলে এসেছে বাড়ি কলকাতার কাজটা আছে কি নেই জানে না। হাতেও টাকাপয়সা আনতে পারেনি। অন্যসময় বছরে আট হাজার টাকা থেকে দশ হাজার এনে দেয়। এবারে  হাত খালি।



মীরা অপেক্ষায়। লকডাউন যদি ওঠে! কিন্তু পরিস্থতি আদৌ স্বাভাবিক হবে কি না ভেবে মুষড়ে পড়েছে একদম। মহাজনের কাছেই বিক্রি করতে হয় গামছা। খুচরো বিক্রেতা নেই। নেই সুতো হাতে। লকডাউন না উঠলে মহাজন আসবে না । বরাতও পাবে না। বন্ধ হয়ে যাবে হাঁড়ি। মীরার মত কারিগররা ধুঁকছে। লকডাউন দেশে নয়, ওদের কপালজুড়ে বসেছে যেন! প্রাণে বাঁচলেও পেটে মরতে হবে । তাও রাজি। কিন্তু মেয়ের পড়াশুনা কি আটকে থাকবে? পরীক্ষার ফি কি মুকুব হবে? মীরার জিজ্ঞাসার সঙ্গে সঙ্গে একরাশ অনিশ্চয়তা ঘিরে ধরছে গোটা পরিবারকে। মীরাদের দীর্ঘশ্বাস অপেক্ষার অন্ধকারকে আরও নিকষ কালো করছে। ভুলে যাওয়া গল্পের গাঁয়ের দৈত্য ফের যেন ডেরা জাঁকিয়ে বসতে চলেছে। ঘরে ঘরে আতঙ্কের প্রদীপ  জ্বলছেই।



  

  

No comments:

Post a Comment

কাথাষ্টিচ শিল্পী সোনালির লকডাউনের দিন

  কাঁথাষ্টিচ শিল্পী সোনালির লকডাউন যাপন    মেয়েদের সুন্দর মুখের নয়, সুন্দর কাজের জয়  সর্বত্র। সাফল্যের সীমানা দিগন্তপার। তাইতো সোনালীদের এত ...