Friday, 1 May 2020

মুসলিম বিয়ের গানের শিল্পী মদিনার লকডাউন

মদিনার লকডাউন সফর 


বদলে গেল সব এক ঝটাকায়! কে জানত লকডাউনের জেরে  নিজের সংসারটাই তুলে নিয়ে আসতে হবে বাপের বাড়ি। মুসলিম বিয়ের গানের শিল্পী  মদিনার স্বামী  আজফার সেখ সৌদিতে আটকে। কাজ আছে কি নেই তাও জানে না আজফার। বাড়িতে পাঠানোর জন্য জমানো টাকাটুকুই বিদেশে সম্বল।  শেষ হয়ে গেলে কি হবে জানা নেই। একটা ঘরে আজফারদের রেখে কোম্পানি তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে। খাবার দিতে লোক আসছে। কখনও দিনে একবারও দেখা নেই। কখনও দুই দিন। স্বামীর কাছে এমন অশান্তির কথা শুনে ভেঙে পড়ে মদিনা। এদিকে অভাবের মধ্যে  শ্বশুর বাড়িতে ছেলে নিয়ে পড়ে থাকতে পারল না মদিনা। তার উপর রোজা শুরু হয়ে গেল। স্বামীও টাকা পাঠাতে পারেনি সংসারে। খরচের বোঝা শ্বশুরবাড়িতে  না বাড়িয়ে  শেষমেশ বাপের বাড়ি ফেরে মদিনা। বাপের বাড়ির হালও ভাল না। বৃষ্টিতে ধানের ক্ষতি হয়েছে । দিন মজুরের  দাম বেড়ে যাওয়ায় ধান কাটা নিয়েও বিড়ম্বনা। মদিনা খুব অসহায় হয়ে বলে, "লকডাউনের জন্য শ্বশুরবাড়ি থেকে পালিয়ে এলাম। এখানেও স্বস্তি নেই। কি যে করি ছেলে নিয়ে!  

মদিনা মুসলিম বিয়ের গান করে। কাজের প্রয়োজনে নানা জায়গায় যাওয়া। গতবার যাদবপুর ঘুরে এসেছে।  আগের মত এখন আর মুসলিম বিয়ের গানের চর্চা নেই। অনুষ্ঠানও বেশি হয় না। এখন বছরে  দুইবার বাইরে যাওয়ার ডাক পায়। বাকি সময় পলিথিন ও পাথরের ব্যাগ ও ফুলদানি তৈরি করে মদিনা। এখন বেকার বাড়িতে বসে। লকডাউনে পাথর,পলিথিন কিছুই পাওয়া যায়নি। হাতে কাজ নেই। আবার  স্বামীর চিন্তা। অন্যদিকে ছেলে রিয়াজের পড়াশুনা নিয়ে উদ্বিগ্ন। স্কুল বন্ধ। বই-খাতা সব তোলা। পড়তে বসালেই ছেলের খাওয়ার বায়না। নইলে ফোনে আব্বার সঙ্গে কথা বলার আবদার। মদিনা এসব নিয়ে জেরবার। ইদে একসঙ্গে তিনমাসের টাকা নিয়ে আসবে। কথা হয়েছিল রিয়াজের আব্বার সঙ্গে এমনটাই। তাই হাত টান ছিলই। কিন্তু লকডাউনের ফলে পয়সার অভাব মদিনাকে একদম অপ্রস্তুত করে দিয়েছে। খুব আড়ষ্ঠ হয়ে মদিনা বলে,"কাকে কি বলবো! চোখের জলে বালিশ ভিজে যাচ্ছে। রাতে ঘুম আসেনা। ছোট্ট সংসারে অভাব ছিলট, কিন্তু শান্তিও ছিল। এখন শান্তি কবে ফিরবে জানিনা।"  
   
                                              
                                                       
মদিনার  মাত্র তেরো বছরেই বিয়ে। চাষবাস করে সংসার কোনোরকমে চললেও অভাব মেটে না। সংসারের হাল ফেরাতে না পেরে স্বামী শেষমেশ গ্রাম ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। মদিনা আগেই  যুক্ত হয় বিয়ের গান ও হস্ত শিল্পে। হাতে কিছু পয়সা না থাকলে ছেলেকে নিয়ে চালিয়ে যাওয়া কঠিন। এই ভেবেই মদিনার কাজে হাত দেওয়া। লকডাউন সেই সফরে এক অনিশ্চয়তা এনে দিয়েছে। মদিনা বলে, "মানুষের আর কি করার ক্ষমতা আছে! নতুন অসুখ। আল্লার কাছে তাই মোনাজাত করছি যে, স্বামীর মুখের আহার যেন কেড়ে না নেয় । ছেলেটার পড়াশুনাটা যেন ঠিকঠাক হয়।"

মদিনার কাছে লকডাউন নিয়ে যত অনিশ্চতা তার চেয়ে অনেক বেশী কষ্ট হাতে কাজ না থাকায়। এতদিনের অভ্যাস। দুপুরে হাত খালি থাকে না কখনও। মদিনা বলে, "কিছু না হলে দলবেঁধে  বিয়ের গানটাও বসে বসে করি। এখন তো দলের অন্য মেয়েরা  আসতেও পারছেনা। ভালোবেসে কাজটা করি তো! নিজের অভাবের কথা বলিনা, ওদেরটা শুনলে মন খারাপ হয়ে যায়! কাজের সরঞ্জাম নেই,গানের ডাকও নেই।" মদিনার  অভাব চেনা। হেঁশেল ঘরে ভাতের হাঁড়িতে চাল না ফুটাতে পারার দিনও দেখা।  অন্যমনস্ক হয়ে বলে, "ভাবছি ছেলের কাছে পড়াটা শিখব। পারব তো দিদি শিখতে? স্বামী মেসেজ পাঠায় মোবাইলে। পড়তে পারিনা। ভাবছি শিখে রাখি যদি কাজে লাগে। যদি কোনও কাজ পাই!"

এমন সরল ও সুন্দর মানুষগুলো কি অসহায় হয়ে পড়েছে আজ! এই দেশের প্রতি গলি,প্রতি মহল্লায় মদিনারা ভিড় করে আছে। এদের কাহিনী বহুদিন ধরে জানা। এদের হাতের রেখা ও ললাট লিখন কেউ বদলানোর কথা ভাবে না । কেননা এত লোকের অভাব কি বদলের? শুধু একজন মদিনার হাত যদি কেউ শক্ত করে ধরত তবে এরা পাহাড় ভেঙে দেখাতে পারত!  প্রায় বছর পয়ত্রিশের মদিনা স্বপ্ন দেখে তার ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া ছেলের কাছে লেখাপড়া শিখে লকডাউনের পর সে একটা কাজ পেতেও পারে!  বিয়ের গান ও হাতের কাজের ফাঁকের দিনকটা  বসে না থেকে কাজ করবে। এই স্বপ্ন দেখার চোখকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয় বার বার। কত লক্ষ -কোটি লোক জগত জুড়ে বেকার হচ্ছে মদিনা জানে না ,জানতে চায়ও না। ওঁর জগতে ও নিজেকে বেকার ও  ঘরে বসা রান্না করা মেয়ে ও মা হিসেবে কখনও দেখতে চায়নি। আজও চায় না। লকডাউন পায়ে বেড়ী পরিয়েছে ঠিকই। কিন্তু মদিনা থেমে থাকার দলে নয়।              
দুর্গাপুর, জীবন্তি, ভরতপুর-২,মুর্শিদাবাদ

No comments:

Post a Comment

কাথাষ্টিচ শিল্পী সোনালির লকডাউনের দিন

  কাঁথাষ্টিচ শিল্পী সোনালির লকডাউন যাপন    মেয়েদের সুন্দর মুখের নয়, সুন্দর কাজের জয়  সর্বত্র। সাফল্যের সীমানা দিগন্তপার। তাইতো সোনালীদের এত ...