Monday, 18 May 2020

অভিবাসী শ্রমিক সন্ধ্যারানির লকডাউনের দিন

 সন্ধ্যারানি সাঁতরার লকডাউন যাপন 
কারা যেন খাবার বিলি করছে শুনে ছুটে যায় সন্ধ্যা সাঁতরা। বাটি নিতে ভুল হয়ে গিয়েছিল সন্ধ্যার । আবার মাঝরাস্তা থেকে ফিরে আসে। এবারে বাটি নিয়ে  লাইনে দাঁড়াতেই  খাবার শেষ। সন্ধ্যার আজ আর খাবার জুটল না। নন্দীগ্রামের সন্ধ্যারানি সাঁতরার জীবনটাই একটা উপন্যাস। লকডাউনে পাতা গুলো উল্টেপাল্টে বেরিয়ে এল। স্বামী মারা গেল  কুড়ি বছর আগে। বাপের বাড়ি ও শ্বশুরবাড়ির সবাই মুখ ফিরিয়ে নিল। সোজা নন্দীগ্রাম থেকে পাড়ি দিল উত্তরপ্রদেশের নয়ডায়। জলপাই থেকে  গৌতম বুদ্ধ নগর এর সফরটা খুব সহজ ছিল না।  নানা জায়গায় কাজ করে অবশেষে ভাগ্য খুলে যায় সন্ধ্যার। একটা রেডিমেট গার্মেন্টস কোম্পানীতে কাজ পায় সন্ধ্যা। নতুন কাজে খুব ভালো চলতে থাকে সব। আড়াই হাজার টাকা দিয়ে ঘর ভাড়া নেয় সন্ধ্যা।  ছুটি না নিলে আয় হতে থাকে মাসে আট হাজার টাকা। লকডাউনের আগেই উনিশ দিনের টাকা দিয়ে দেয় কোম্পানী। সেই টাকা দিয়ে ঘর ভাড়া ও সংসার চলে যায় সন্ধ্যার। এবারে সমস্যার শুরু। সন্ধ্যা আর চালাতে পারছে না। প্রতিদিন বাটি হাতে লাইন দিয়ে খাবার নিতে যাচ্ছে। কোনোদিন পাচ্ছে। কোনোও দিন পাচ্ছে না। মুশকিল হল লকডাউনে কোম্পানী খুলেছে কিন্তু সন্ধ্যার ডাক পড়েনি। খুব অল্পসংখ্যক কর্মী নিয়ে ফ্যাক্টরি কজ চালাচ্ছে। সন্ধ্যা বড় আশা নিয়ে প্রতিদিন যাচ্ছে আর ফিরে আসছে। সন্ধ্যা কেঁদে বলে, "সব দুঃখ সহ্য করেছি, লাইনে দাঁড়িয়ে হাত পেতে খাবার নিচ্ছি। আমার এই একযুগ ধরে খেটে খাওয়ার জীবনে এমন খারাপ সময় দেখিনি।"



সন্ধ্যা  মাত্র চার ক্লাস পাশ  করেছিল।  স্বজন হারিয়ে বিদেশে এসে বাস করছে।  বাংলায় কথা বলার কেউ নেই।  নিজের খেটে খাওয়ার উপর ভরসা ছিল।  তাই কখনও ভয় পায়নি। এখন খুব উদ্বেগের সঙ্গে দিন কাটছে।  খাবার নেই, চেনা লোক নেই। একা ও অসহায় হয়ে পড়েছে সন্ধ্যা। নিজের উপার্জনেই মেয়ের বিয়েও দেয়। যাবতীয় সাংসারিক দায়িত্ব মাথায় তুলে নিয়েছে একের পর এক। এখন নিজের কাছেই নিজে বোঝা হয়ে গেছে। ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলছে। কাজটা যদি ফিরে না পায় সেই আশঙ্কাও মাথায় চড়ে বসেছে। বয়স পেরিয়েছে পয়তাল্লিশ। আর কি কাজ পাবে কোথাও? মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে সন্ধ্যার। সন্ধ্যারানি সাঁতরা কাজ ছেড়ে মেয়ের কাছে থাকবে সে ইচ্ছাও নেই। জামাই এর বোঝা হতে চায় না। বাড়ি ভাড়া গত দুই মাসে মিটিয়েছে। আগামীতে কি হবে জানেনা সন্ধ্যা। 

এই লকডাউনে সন্ধ্যার মত মহিলাদের  সম্মান নষ্ট করে দিল। নিজের উপার্জনের অহংকার কেড়ে অন্যের সহানুভূতি ও দয়ার পাত্র করে দিল। সন্ধ্যা আপশোস করে, "নিজের জোরেই কাজ খুঁজেছি, নিজের জোরেই পড়ে আছি বাইরে কিন্তু এই লকডাউনে পরভরসা হয়ে গেলাম।" 

সন্ধ্যার ফেরার পথ নেই ঘরে। ওখানে রুজি-রুটির অনিশ্চয়তা এনে দিয়েছে লকডাউন। কাজ করা খেটে খাওয়া মেয়ের থেকে মুখ ঘুরিয়েছে অনেক আগেই আত্মীয় -পরিবার। এখন এক অনিশ্চিত জীবনের সঙ্গে ঘর। সন্ধ্যা ভাঙা গলায় বলে, "একটু সাহায্য করবেন?" একথাটা বলতে গিয়ে গলা বন্ধ হয়ে আসে সন্ধ্যারানি সাঁতরার।  কষ্ট করে বলে, "জগতে মেয়েদের জন্য সবকিছু খুব কঠিন।"
 জলপাই,নন্দীগ্রাম,পূর্ব মেদিনিপুর।

No comments:

Post a Comment

কাথাষ্টিচ শিল্পী সোনালির লকডাউনের দিন

  কাঁথাষ্টিচ শিল্পী সোনালির লকডাউন যাপন    মেয়েদের সুন্দর মুখের নয়, সুন্দর কাজের জয়  সর্বত্র। সাফল্যের সীমানা দিগন্তপার। তাইতো সোনালীদের এত ...