Sunday, 24 May 2020

অভিবাসী শ্রমিক কাকলীর তালাবন্দির দিন

 কাকলীর লকাউন যাপন

বাড়ি ফিরতে অভিবাসী শ্রমিক কাকলীকে ধার করতে হয়েছে দশ হাজার টাকা। বাসে দিল্লি থেকে রায়গঞ্জ। মা ও ছেলের ভাড়া দশ হাজার টাকা। সেখান থেকে আরও তিনশো টাকা ভাড়া দিয়ে বহরমপুর ফেরা। কাকলি গৃহপরিচারিকার কাজে যায় দিল্লি। সেখানে নিজের চব্বিশ বছরের ছেলেকেও ডেকে নেয়। ছেলের মাত্র দুই দিন কাজ করার পরেই লকডাউনের ঘোষণা দেয়। এদিকে লকডাউনের জন্য শেষ মাসের কাকলীর  মাইনেও বাকি থেকে যায়। হাতে পর্যাপ্ত নগদ টাকা না থাকায় কাকলিকে পালিয়ে আসতে হয়। ওখানে থাকলে অনাহারে কাটাতে হবে। বাড়ি ফিরে এলে অন্তত আত্মীয় পরিজনের কাছে সাহায্য পাওয়া যাবে। সেই ভরসায় টাকা পয়সা ধার করে বাড়ী আসা। এখন হোম কোয়ারান্টাইনে আছে মা -ছেলে। ইদে একদম খালি হাত। ঘরে বন্দি। খাবার নেই। আত্মীয়রাও দেখা করতে আসতে পারছে না। খুব অসহায় হয়ে পড়েছে কাকলী। অভাবের তাড়নায় ঘর ছেড়েছিল। কিন্তু নতুন অভাবের ভার  নিয়ে ফিরল বাড়ি। খুশির ইদ বিষাদে ভরল। না মিলল বখশিস। না মিলল নতুন জামাকাপড়।  কাকলির আপশোস, "জোয়ান ছেলেটা ঘরে পড়ে রইল। ছেলেটার  তো ইদ ভালো করে পালনের কথা ছিল । কিন্তু এত টাকা ধার  করে এমন মন খারাপ যে আমাদের আর ওঠার ক্ষমতা নেই।"



এই দেশের দ্বিতীয় জনপ্রিয় পেশা এই পরিচারিকার কাজ। এদের ছুটি ও অসুস্থতা নিয়ে নেই আলাদা  কোনও ব্যবস্থা। সারাবছর জাঁতাকলে পিষ্ট। মাসের প্রথম দিনে মেলে না মাইনেও। সবটাই বাড়ির মালিকের উদারতা ও ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। অনলাইন এজেন্সি এখন কাজের মেয়ে খুঁজে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছে। জায়গাভেদে গৃহ কাজ ও বেবি সিটার অনলাইনের মাধ্যমেও বুক করা যায়। সিটি গুলিতে সারাদিনের মেইড নেয়  নয় হাজার থেকে  এগারো হাজার। দিনের অর্ধেক সময় কাজ করলে পায়  ছয় থেকে আট হাজার টাকা।  কিন্তু  কাকলীদের মত পরিচারিকাদের খুব কম টাকায় কাজ করতে হয়। বার বার কাজও ছাড়তে হয়। ছেলের অসুখ বা বাড়ির মেরামতির জন্য দুই দিন না গেলেই কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়।  আবার মালিকের মুখের উপর জবাব দিলেও ছাড়তে হয় কাজ। শীতের পোশাক ও বর্ষার ছাতার জন্য  অনেক মুখ ঝামটা সইতে হয়েছে তাকে। বিপদ কাটিয়ে সকালে হাজির হতেই জেনে গেছে  কাজটা তার চলে গেছে। পরে এসে পয়সা হিসেব করে নিয়ে  যেতে বলা হয়েছে। ব্যবহার করতে দেওয়া হয়নি পরিবারের বাথরুম। এই রকম  প্রভু-ভৃত্যের অবস্থান থেকেই কাকলী পালাতে চেয়েছিল। পয়সা আর সম্মান দুটোই যখন নেই তখন দেশের মাটি কামড়ে পড়ে থাকা কেন? তাই কাকলী পাড়ি দেয় দিল্লির অচেনা মাটিতে। কিন্তু কপাল সঙ্গ দিল না। লকডাউন ভাগ্যের রেখা বদলাতে দিল না।

কাকলী বলে, নিজের দেশে অনেক শিক্ষিত বাড়িতে কজ করেছি। কিন্তু সম্মান কোথাও  সেভাবে পাইনি। বাইরে সম্মান না থাকলেও টাকাটা বেশী  তাই ছুটেছিলাম। মা-ছেলে কাজ করে ভেবেছিলাম দিন বদল হবে। কিন্তু কাজের মেয়েদের কি তাই হয়? শিক্ষিত মানুষেরাই তো ভালবাসতে পারল না আমাদের । আমাদের এখনও
 অনেকে ছোটোলোকই ভাবে!  ঘর মুছি,বাসন মাজি কিন্তু কোনোদিন ও নিজের ডাইনিং টেবিলে বসে খেতে বলেনি কেউ। এমনকি যে সোফা প্রতিদিন ঝাড়ি-মুছি সেখানে বসতেও দেয়নি একদিন।  মার্বেলের বাথরুম পরিষ্কার করি কিন্তু একদিনও স্নান করতে দেয়নি কেউ। 

কাকলি দুঃখ করে বলে, " মান -সম্মান আমাদের নেই এটাই সবাই ভাবে। কাজের  অনুপাতে মূল্য পায় না সয়ে যায়। কিন্তু মানুষ হয়ে মানুষকে ছোট করে সেটাই খারাপ লাগে। অভাব তো আমাদের চিরকাল। লকডাউন শুধু ধার বাড়িয়ে দিল। হাত পাতা ছাড়া উপায় রাখল না কোনও।"

বহরমপুর ,মুর্শিদাবাদ।

No comments:

Post a Comment

কাথাষ্টিচ শিল্পী সোনালির লকডাউনের দিন

  কাঁথাষ্টিচ শিল্পী সোনালির লকডাউন যাপন    মেয়েদের সুন্দর মুখের নয়, সুন্দর কাজের জয়  সর্বত্র। সাফল্যের সীমানা দিগন্তপার। তাইতো সোনালীদের এত ...