Saturday, 9 May 2020

রাঁধুনি সাগরিকার লকডাউনের দিন


সাগরিকার লকডাউন যাপন

লকডাউনে রান্নার কাজ বন্ধ হয়েছে সাগরিকার অনেকদিন। আগে রান্নার কাজ করত বাড়িতে। তারপর মাসে দুই হাজার  টাকার বিনিময়ে এক বেসরকারি অফিসে রান্নার কাজ ধরে। সাগরিকাকে অভাবের বাইরে তাড়া করে নিয়ে বেড়াচ্ছে অন্য এক সমস্যা। দিনে দিনে তা বেড়েই চলেছে। শোকে-তাপে-চিন্তায় সাগরিকা বাড়িতে এখন শয্যাশায়ী। বিছানাই তাঁর সংসার। আগে তা-ও কিছু মুখে দিচ্ছিলেন। এখন সে সবও বন্ধ। পনেরো বছর আগে, বলা নেই, কওয়া নেই, স্বামী হঠাৎ হারিয়ে গেলেন!সেই ধাক্কা সামলে নিয়েছিলেন সাগরিকা। সন্তানের মুখ চেয়ে। মেয়ের মুখ চেয়ে। স্বামী নেই। সন্তান তো আছে। তাকে আঁকড়েই না হয় কাটিয়ে দেবেন জীবনের বাকি দিনগুলো। মেয়েটাও লেখাপড়ায় বড় ভাল। খুশির হাওয়া ছিল সংসারে। কিন্তু জানুয়ারিটাই যেন নষ্টের মূলে! সেই যে মেয়ে টিউশন নিতে গেল, আর ফিরল না। সাগরিকা প্রথমে ভেবেছিলেন, ভগবান বুঝি শেষ সম্বলটাও কেড়ে নিলেন।


কিন্তু, পরে তিনি জানলেন, ভগবান নয়, মেয়েটাই চলে গিয়েছে। স্বেচ্ছায়, নাকি চাপে তা জানেন না সাগরিকা। তাই তিনি দৌড়ঝাঁপ শুরু করলেন। খুঁজে পেলেন মেয়ের সঙ্গীর ঠিকানা । সেখানেই গিয়ে মেয়ের খোঁজ করলেন। কিন্তু ব্যর্থ হলেন। প্রথমে নিরুদ্দেশের ডায়েরি। তার পরে সেই আইনেরই আশ্রয়। মেয়েটাই তো তাঁর সব। জীবনের শেষ সম্বল।

জানুয়ারি মাস থেকে নেই নেই করে অন্তত ৬০ বার ছুটেছেন নানা দফতরে। না,হন্যে হয়ে খুঁজেও  হদিস পেলেন না মেয়ের কোনোও। লকডাউনের গেরোয় কিছুই আর নাকি হওয়ার নেই। জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে মেয়েকে পাওয়া যাচ্ছে না। এই শুনে  মায়ের মন কি মানে! জলজ্যান্ত বারো ক্লাসে পড়া মেয়েটা হারিয়ে যাবে? এ কেমন কথা!  সাগরিকার একটিই ভয়, এই বিপদের দিনে মেয়েটার যদি কিছু হয়ে যায়? একেই রোগ ছড়িয়ে রয়েছে চারপাশে! অন্যদিকে, মেয়েটারও উচ্চ মাধ্যমিক দেওয়া হল না!

হতাশ সাগরিকা বলছেন, "লকডাউন তো আজ শুরু হয়েছে। মেয়েকে পাচ্ছি না সেই জানুয়ারি থেকে। আমরা গরিব বলে কি মেয়েটা বেঁচে আছে কিনা তা-ও জানতে পাব না?" সাগরিকার বোন দীপিকা কাঁদতে কাঁদতে বলেন ,"দিদির স্বপ্ন ছিল মেয়েকে পড়ানো। নিজে তো ক্লাস সিক্সের  পরে আর পড়তে পারেনি। স্বামী হারিয়ে যাওয়ার পরে নয়নের মনি ছিল ওই মেয়েই। সে-ও হারিয়ে গেল। বাবার মতোই!"

সাগরিকার যুদ্ধ জটিল আবর্তে ঘুরপাক খেয়েছে আজীবন। বাবার একটি হাত ছিল না। সাগরিকা ও দীপিকা দুই মেয়েকেই খুব কষ্টে মানুষ করেছেন। বিপদের দিনে  মাথায় হাত রাখার কেউ ছিল না।  পুরো জীবনটাই লড়াই করে চলা। আজকের কর্মবিরতির যন্ত্রণা সয়ে নিচ্ছে সাগরিকা। কিন্তু মেয়ে হারানোর শোক কী করে ভুলে থাকা যায়! তাই উধাও হয়ে যাওয়া মেয়ের অপেক্ষার প্রহর গোনে যন্ত্রণা। বিরামহীন পদচারণায় ক্লান্তি নেই। সদর থেকে ঘরের কাছের থানায় গিয়ে প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থাকা। হাজার না শুনেও থামে না সাগরিকা। মেয়ের প্রত্যাবর্তনের বিশ্বাস নিয়ে প্রতিদিন আঁচলের পয়সা বেঁধে রিক্সা ঘোরায় থানার দিকে। দাঁড়িয়ে শুধু দাঁড়িয়ে কাটিয়ে দেয় ঘন্টার পর ঘণ্টা। 

তথ্য ও সমীক্ষা জানাচ্ছে, এই দেশে গড়ে প্রতিদিন হারিয়ে যান ২৭০ জন মহিলা ও শিশু। কিন্তু তাদের মধ্যে তো কেউ কেউ ফিরেও আসে!পুলিশ নয়, প্রশাসন নয়, বৃথা আশা মরতে মরতেও মরে না জেনেই সেই আশাতে বুক বাঁধছেন সাগরিকা! লকডাউন শেষ হলে হয়ত মেয়ে নিজেই এসে দরজায় কড়া নাড়বে!  মেয়ে নিয়ে সব অপমান ,অসম্মান আর অসহায়ত্বের দিন একদিন শেষ হয়ে যাবে।
হরিগঞ্জ,রেজিনগর,মুর্শিদাবাদ

No comments:

Post a Comment

কাথাষ্টিচ শিল্পী সোনালির লকডাউনের দিন

  কাঁথাষ্টিচ শিল্পী সোনালির লকডাউন যাপন    মেয়েদের সুন্দর মুখের নয়, সুন্দর কাজের জয়  সর্বত্র। সাফল্যের সীমানা দিগন্তপার। তাইতো সোনালীদের এত ...