সোনালির লকডাউন যাপন
"সরকার এত সাহায্য দিচ্ছে শুনছি। কিন্তু আমাদের লোনের এই তিনমাসের টাকাটা মুকুব করে দিতে পারে না?" সোনালি হাজরার এখন এটাই জিজ্ঞসা। পনেরো বছর ধরে সোনালি পাটের ব্যাগ ও ম্যাট তৈরি করে। লকডাউনের জন্য ঘরে পড়ে থাকল প্রায় হাজার তিরিশের তৈরি জিনিষ। কলকাতায় মেলাতে যাওয়ার জন্য তৈরি ছিল বাড়তি মাল। সেটাও বাতিল হয়েছে। তাই ব্যাগ, ম্যাট যাবতীয় জিনিষ ঘরবন্দি। পাইকারী বিক্রীর উপায়ও বন্ধ। প্রতিদিন দলের মেয়েদের অভাব-অভিযোগ শুনে একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে সোনালি। নিজের পরিবারে অশান্তি কি কম! স্বামী লেবার। তিন জায়গায় অন্তত বারো হাজার টাকা পাবেন। কিন্তু হিসেব করেও পেলেন না টাকা। এখনও দিচ্ছি ও দেবো চলছেই।
বিয়ে করে সোনালি এসেছিল পাকা ঘরে। শাশুড়ি স্বনির্ভরগোষ্ঠীর দৌলতে গেঁথে ফেলেছিল ইটের দেওয়াল। কিন্তু সেই ঘরে অভাব কখনও এসে পড়বে ভাবেনি সোনালি। ঘরে রেশনের চাল আছে। আটাও আছে। বাকি কিছু কেনার ক্ষমতা নেই। সোনালি আপশোস করে বলে,"ইটের দেওয়াল থাকলে কি অভাব থাকে না দিদি? গ্যাসের পাশে যে আখার উনুন সেটাও খুব বড় সত্যি। পঞ্চাশ দিন বাড়িতে বসে। আমার কাজও বন্ধ অনেকদিন। টাকা কোথায় পাবো?"
সবিতার ছোট ছেলে মাত্র দ্বিতীয় শ্রেণি। সে তো কিছু বোঝে না। নবম শ্রেণির বড়টা একটু অবস্থা বুঝলেও ছোটটি একেবারে অবুঝ। তাই প্রতিদিন খাবার নিয়ে অশান্তি চলছেই। তাতে সোনালি খুব বেশী বিব্রত নয়। কিন্তু গোষ্ঠীর মেয়েরা উপকৃত হলেও আসল উদ্দেশ্য থেকে অনেকেই সরে আসছে। এই নিয়ে সোনালি বেজায় ভাবিত। গোষ্ঠীর অনেক মেয়েই যে ঋণ নিচ্ছে তা দিয়ে মেয়ের বিয়ে দিচ্ছে। নইলে সংসার চালাচ্ছে। টাকা জীবনের কাজে লেগে যাচ্ছে। জীবিকায় সক্ষমতা ও বাড়তি আয় বাড়ানোর কাজটা বাকি পড়ে থাকছে। তাই সামাজিক পরিবর্তন ও গ্রামের উন্নতির ভাবনা অনেকটাই পেছনে পড়ে রয়েছে।
সোনালি বলে,"স্বনির্ভরতা ও সক্ষমতা আর এক কথা নেই গো দিদি! সরকার যাদের স্বনির্ভর করার কথা বলছে তারা কি সক্ষম হতে পেরেছে? আজ আমি তো সক্ষম নই! এমন অবস্থা চলতে থাকলে আমাকেও কাল অন্যের সাহায্যে নিয়েই বাঁচতে হবে। সম্মানের আড়াল আর থাকবে না! কিন্তু আমি তো খেটেই খাই।"
লকডাউনের মত পরিস্থিতি সোনালিদের অভাবি বানায়। তাই এই অসময়ে সরকারের কাছে হাত পাতা ছাড়া আর কি করতে পারে সোনালিরা ? সোনালি বলে, "অসময়ে সম্মান বাঁচানোর জন্য যদি গোষ্ঠীর মেয়েদের কোনও পলিসি বা বীমার আওতায় এনে ফেলত তবে মুখ রক্ষা হত।সারাবছর খেটেও যদি ধার করে খাই বা শোধ দিতে না পারি কেমন লাগে বলুন?"
সোনালির এই খারাপ লাগা একার নয়। লকডাউনের জন্য স্বনির্ভর গোষ্ঠীর অনেক মেয়েদের এই খারাপ লাগা নিয়ে চলতে হবে আগামী দিনে। মাসের মিটিং এবং হিসেবের খাতা সব বন্ধ পড়ে। ফিল্ডে পড়ে আছে অনেক টাকার জিনিষ। ডেলিভারী না দিতে পারলে আবার সেই নতুন ঋণের ফাঁদ। আবার সেই শোধ করতে না পারার হাহাকার। আবার সেই অক্ষমতার গল্প প্রতিদিন বারান্দা-চৌকাঠ জুড়ে।
হাজরাপাড়া ,ইসলামপুর,মুর্শিদাবাদ
মর্মভেদী।
ReplyDelete