ক্যাটারিং ব্যবসায়ী পূর্ণিমা মন্ডলের লকডাউন যাপন
কয়েকটা বিয়ে ও একটি জন্মদিনের অর্ডার ছিল ক্যাটারিং এর। অনুষ্ঠান বাতিল হয়েছে লকডাউনের জন্য। বাকি তিনটি হয়ে যাওয়া অনুষ্ঠানের টাকা পাওয়া গেল না। সকলেই "পরে দিচ্ছি" জানিয়ে দিল। ব্যবসায় টাকা ফেঁসে যাওয়ার যে কি বিষ তা হাড়ে হাড়ে টের পেলেন ক্যাটারার ব্যবসায়ী পূর্ণিমা মন্ডল। মাত্র তিন বছরের ব্যবসা একটু মাথা তুলতেই নুয়ে পড়ল যেন! বন্ধ হওয়া অনুষ্ঠানের জন্য আগাম কিছু টাকাও খরচ হয়ে গিয়েছিল। সেই টাকা আটকে রইল। আবার নতুন করে অনুষ্ঠানের দিন কবে স্থির হবে একদম অজানা পূর্ণিমার। জীবনের নানা ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে একটু স্থিতু হয়েছিল পূর্ণিমা। স্বামীকে কিনে দিয়েছিল টোটো। ক্যটারারের ব্যবসায় নিজের ভাই ও স্বামীকে সঙ্গে নিয়েছিল। নিজের ক্যাটারিং এ যুক্ত কর্মীর কাপড় কেচে দেওয়া ও হিসেবের খাতা দেখার জন্য লোক রাখেনি আলাদা করে। কিছুটা খরচ কমানোর ইচ্ছে থেকেই নিজেই দুই হাতে কাজ করেছে এতদিন। কোথাও কোনও ঘাটতি রাখেনি সততার। ক্যাটারিং এর ব্যবসা ছিল পূর্ণিমার নিজের পরিবার।
ব্যবসা শুরুর মাত্র বছর দুই আগেই পরিস্থিতি ছিল অন্যরকম। একদিন চুপিচুপি স্বামী ও মেয়েকে নিয়ে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয় পূর্ণিমা। অভাবের সামনে পড়ে দিশেহারা হয়ে যায় । টানা ছয় মাস কোনো কাজ নেই স্বামীর হাতে। স্বামীও সায় দেয়। তিনজনেই বিষ খাবে। স্থির হয়। কিন্তু ভোর হবার আগেই বদলে ফেলে সিদ্ধান্ত। নিজেদের জীবনের মূল্য হারালেও মেয়ের প্রাণ বাঁচানোর দায় থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারে না পূর্ণিমারা। দুর্দিনে না খেয়ে থাকা থেকে শুরু করে তিনজন তিনটে আলু সেদ্ধ খেয়েও দিন কাটিয়েছে। তারপরেও চরম অভাবের দিনে মেয়ের মুখের হাসির দিকে তাকিয়ে এই মন্ডল দম্পতি সিদ্ধান্ত বদলাতে বাধ্য হয়। নতুন সকালে নতুন করে শুরু করে পূর্ণিমারা। মেয়েকে মানুষ করার অদম্য আকাঙখা থেকে আবার যাত্রা শুরু। মেয়ের স্বপ্নে বাবা-মায়ের নতুন সফর শুরু হয়। বেঁচে থাকার নতুন ইচ্ছা জাগে।
অষ্টম পাশ পূর্ণিমার স্বচ্ছল ও শিক্ষিত পরিবারেই বিয়ে হয়। কিন্তু স্বামী একটু বেপরোয়া হওয়ায় নানা জটিলতার মধ্যে দিয়ে দিন কাটে। বাড়তি ঝামেলা এসে পড়ে একের পর এক। স্বামীর সাজা হয়ে যায়। জেল থেকে নিজের হাতে ছাড়িয়ে নিয়ে আসে। একা লড়ে যায় পূর্ণিমা। কিছুতেই হার মানে না । নিজের সব উজার করে সংগ্রহ করে ক্যাটারিং এর ব্যবসার জন্য টাকা। ঋণ করে নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে। তারপর স্বামীকে নিরন্তর উৎসাহ দেয়। ব্যবসায় গতি আসে। স্বামীর টুকটুক থেকেও আয় হতে থাকে টাকা। সবমিলিয়ে খুব সাফল্য আসে পূর্ণিমার নতুন ব্যবসায় ও পরিকল্পনায়।
লকডাউন লিখে দিল কপালে নতুন বিপর্যয়। টুকটুক ঘরে বসে থাকল দুই মাস । লকডাউনে অনুষ্ঠান একের পর এক বাতিল হল তাই টাকা আটকে থাকল। হাত হয়ে গেল ফাঁকা। আরপরে লোনের মাসের টাকা মিটিয়ে টাকা শেষ। নগদ টাকা কি করে যে হাতে ফিরে আসবে এবং কখন তা নিয়ে একদম অন্ধকারে পূর্ণিমা। পূর্ণিমা বলে, "কি সংগ্রাম করে এই ব্যবসা করা,স্বামীকে বেঁচে থাকার পথ দেখানো বলে বোঝাতে পারবো না। জীবনের আশা যে ছেড়ে দেয়, তাকে জীবনে ফেরানো যে কী কঠিন,সে আমিই জানি।"
পূর্ণিমা বলে, "আমার মত অনেকেরই সামনে কঠিন দিন আসছে। জানিনা কি করে কি হবে। আসলে টুকটুকটা চললে হয়ত কিছুটা সামাল দেওয়া যেত সংসার। লকডাউন এভাবে সুখের দিনে আগুন লাগিয়ে দেবে কল্পনাও করিনি।" পূর্ণিমা বলতে শুরু করে মেয়ে আর স্বামী নিয়ে কিভাবে ব্যবসাটা মেয়ের নামেই শুরু করেছিল । অনেকটা সামনের দিকে এগিয়েও গিয়েছিল। এখন থমকে। আগামীতে শুধু অনিশ্চয়তা আর অন্ধকার।
অন্যমনস্ক পূর্ণিমা বলে,"এত বছরের দাম্পত্যের সুখ শান্তি কেড়ে নিয়েছে এই লকডাউন। একটিই জীবন,কতবার শুরু করা যায়!"
ভাকুড়ি,মুর্শিদাবাদ
No comments:
Post a Comment