কালোনের লকডাউন যাপন
কে জানত লকডাউনের সঙ্গে প্লাস্টিকের এমন গভীর সম্পর্ক! বৃষ্টি হলে মানুষ কি করে? ভিজে যাওয়া থেকে বাঁচতে ঘরে আশ্রয় নেয়। বাইরে ছাতা সঙ্গে নেয়। কালোনরা কি করে? বৃষ্টিতে নাগাড়ে ভেজে। অঝরে চোখের জলের সঙ্গে পাল্লা দেয় বৃষ্টির জলরাশি। দুই হাত তুলে কালোনরা অভিযোগ করে আল্লাহর কাছে- "ম্যাঘ-পানি দিলা তো গরীবের ছাদ কেন দিল্যা না!" কালোনের নেই মাথার ছাদ। নেই একটা ছাতাও। খোলা আকাশ ও নিজের মাথার মধ্যে শুধু পাতলা এক প্লাস্টিকের আড়াল। রাত-দিনের হঠাৎ বৃষ্টিতে প্লাস্টিকের প্যাকেট মাথায় দিয়ে অপেক্ষা। প্রতি বছর একশো টাকায় একটা প্লাষ্টিক কেনা হয়। সেটা ছিঁড়ে গেলে আবার খোলা আকাশ। এবারে সেই প্লাষ্টিক কিনতে বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করতে হবে জানা ছিল না কালনের। বৃষ্টির সঙ্গে অভাবের এই লুকোচুরি কালোনদের জীবনজুড়ে। এই অভাবের মধ্যে নতুন সঙ্গী লকডাউন। লকডাউনে ঘরে নিজেকে বন্দি করার নিরাপদ আশ্রয়টাও নেই। ভাইরাস এসে পড়লেও কঠিন,পালিয়ে যাওয়ার পরেও মুশকিল। কালোনের অবস্থা এখন জলের বাইরে মাছের মত। ছটপটিয়ে কষ্ট পাওয়ার দিন লাগাতার জারি।
সতেরো বছর বিড়ি বাঁধছে কালোন। বিবি থেকে বেওয়া হয়েছেন। এখন তো কালোন চোখেও কম দেখে। এতদিনের বিড়ি শ্রমিক কালোনের নেই কোনও বিশেষ সামাজিক সুবিধার স্বীকৃতি। বিড়ি শ্রমিক হিসেবে রেজিষ্ট্রেশনের বিষয়ে কিছুই জানতে পারেনি আজীবন। কেউ একটা চশমারও ব্যবস্থাও করেনি। কিন্তু নাগাড়ে হাতের কাজ চলছেই। লকডাউনে বন্ধ বিড়িবাঁধা। হপ্তায় সাড়ে তিনশো টাকা উপার্জনের পথও বন্ধ। ছেলে মারা গেছে অনেক আগেই। বৌমা অন্যত্র সংসার বেঁধে নিয়েছে। নিজের মেয়েটাও দুই দিনের বাচ্চা রেখে পৃথিবী ছাড়ল। সেই নাতনিকে নিয়ে কালনের সফর। বয়স হয়েছে । স্বামীর ভিটেতে কয়েকটা কঞ্চি দিয়ে ছিল কাদার দেওয়াল। টালির ব্যবস্থা করে কালন উঠতে পারেনি । জীবন ফুরিয়ে গেল। মাথার উপরে ছাদের স্বপ্নপূরন হল না। এখন তো আবার পেটে টান। নাতনি ও নিজের খাবারের জন্য রেশন ও বিড়ির উপার্জন ছাড়া কিছুই ছিল না।
সতেরো বছর বিড়ি বাঁধছে কালোন। বিবি থেকে বেওয়া হয়েছেন। এখন তো কালোন চোখেও কম দেখে। এতদিনের বিড়ি শ্রমিক কালোনের নেই কোনও বিশেষ সামাজিক সুবিধার স্বীকৃতি। বিড়ি শ্রমিক হিসেবে রেজিষ্ট্রেশনের বিষয়ে কিছুই জানতে পারেনি আজীবন। কেউ একটা চশমারও ব্যবস্থাও করেনি। কিন্তু নাগাড়ে হাতের কাজ চলছেই। লকডাউনে বন্ধ বিড়িবাঁধা। হপ্তায় সাড়ে তিনশো টাকা উপার্জনের পথও বন্ধ। ছেলে মারা গেছে অনেক আগেই। বৌমা অন্যত্র সংসার বেঁধে নিয়েছে। নিজের মেয়েটাও দুই দিনের বাচ্চা রেখে পৃথিবী ছাড়ল। সেই নাতনিকে নিয়ে কালনের সফর। বয়স হয়েছে । স্বামীর ভিটেতে কয়েকটা কঞ্চি দিয়ে ছিল কাদার দেওয়াল। টালির ব্যবস্থা করে কালন উঠতে পারেনি । জীবন ফুরিয়ে গেল। মাথার উপরে ছাদের স্বপ্নপূরন হল না। এখন তো আবার পেটে টান। নাতনি ও নিজের খাবারের জন্য রেশন ও বিড়ির উপার্জন ছাড়া কিছুই ছিল না।
শাড়ির ছেঁড়া আঁচল ঘুরিয়ে মাথার উলটো দিকে টেনে নেয় কালোন । ভাঙা গলায় বলে, "লোক আসে। অভাব নিয়ে জিজ্ঞাসা করে,চলে যায়। গরীবের কেউ নেই। র্যাশন টুকুই ভরসা।" কালোনের বুক জুড়ে কষ্ট আছে, অভিমানও আছে। রোজার সময় এখন ভোরে শুধু ভাত আর লংকা। ইফতারে নুন ভাত দিয়েই চলছে। মসজিদ থেকে মাঝে মাঝে ইফতার আসছে। নাতনির জন্য সেটা তুলে রাখে কালোন। অভাবের দিনে নাতনিকেও বিড়ি বাঁধতে শেখায় কালন। দুজনে মিলে সংসারের হাল ধরে শক্ত করে। চেয়ে খাওয়ার চেয়ে নিজের উপার্জনেই ভরসা কালোনের। এভাবে যে সব বন্ধ হয়ে যাবে কে জানত!
কত বয়সে বিয়ে মনেই নেই কালোনের। স্বামীর অসুখ ও মৃত্যুর পর অনেক রাত কেটেছে কালোনের। একাই সেসব নিজের হাতে মোকাবিলা করেছে। তিন দফার লকডাউউনে কালোন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। দিনের শেষ কিছুতেই হচ্ছে না কালোনের। মাথায় হাত দিয়ে বলে, খোদা বাঁচিয়ে নিলেন, রোজা না আসলে ভুখা পেটে এমনিই থাকতে হত এই ক' টা দিন।"
রাজ্যে এগারো লাখের বেশি মহিলা বিড়ি শ্রমিকের একজন কালোন। বিড়িতে নিয়োজিত কর্মীসংখ্যার নব্বুই শতাংশ মহিলা- শিশুদের একজন। একযুগের বেশি বিড়ি শ্রমিক হিসেবে কিছু পয়সা খেয়ে পড়ে কালোনের হাতে থাকার কথা! সেটা দিয়ে লকডাউনের অভাব সামাল দেওয়া যেতেই পারত। এর মূল কারণ বিড়ির সঠিক মজুরি না পাওয়া। বাতিল হয়ে যাওয়া বিড়ির দাম ও প্রাপ্য মজুরির হিসেবে বোঝপাড়া হয়ে যাওয়া। সেখানে কালনের কিছু করার নেই। শ্রমের সমান মজুরি দাবির অধিকারও নেই। কালোনদের গোটা একটা জীবন পেরিয়ে গেল। আজও সুরাহা হয়নি শ্রমের মর্য্যাদার। অসময়ে নিজের পেট চালানোর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা থাকলে এভাবে কালনকে হাহাকার করতে হত না। ছেঁড়া শাড়ির দৈন্যতা না ঢাকতে পারলেও নুন-ভাতের কোথায় চোখ ভরে আসত না। লকডাউন তার কাছে দূর্ভিক্ষের মত চেহারা নিয়ে হাজির হতে পারত না।
No comments:
Post a Comment