Wednesday, 6 May 2020

অভিবাসী মহিলা শ্রমিকের লকডাউনের দিন

অভিবাসী  মহিলা শ্রমিকের তালাবন্দি জীবন



পাঞ্জাবের গ্যাসপুরায়,বিজলী দপ্তরের তিন নম্বর গলি। লকডাউনে আটকে পড়েছেন একদল মহিলা শ্রমিক।  নিজের ঘর হরিহরপাড়া,মুর্শিদাবাদ থেকে ১৮০০ কিলোমিটার দূরে বসে এদের কান্না থামছেনা। কাছের ষ্টেশন লুধিয়ানা। মাথাপিছু ট্রেনভাড়া নাকি  ৭৫০ টাকা। ওদের কাছে ভাড়া নেই।  ফিরিয়ে  ঘরে নিয়ে আনার কেউ নেই। মহিলারা কেউ  ফেলে এসেছে বাচ্চা বাড়িতে। কেউ নিয়েছে সঙ্গে। বছর দুই  এর  সরফরাজ কেঁদেই চলেছে। খাবার বন্ধ হয়েছে চার দিন। দিনে ষাটবার করে হেল্পলাইনে ফোন করছে ওদের স্বামীরা। কিন্তু কোনও সাড়া নেই। সরকারী লাইন  থেকে নাকি বলেছিল যে রেশনের ব্যবস্থা করা হবে। সেটাও করা হয়নি। এখন রোজা করছে এক টুকরো বিস্কুট খেয়ে।

জরিনারা কেউ টায়ার বানানোর সহায়কের কাজ করে। কেউ ফ্ল্যাটবাড়িতে। কেউ করে দেহারি কাজ। দিনে কেউ  দুশো টাকা মজুরি পেত । কেউ বা একশো টাকা। ইদের আগে হিসেব করে টাকা নেবে এমনটাই ছিল পরিকল্পনা। কিন্তু লকডাউন হওয়ায় টাকাও মেলেনি। এখন তো ফেরার ভরসাও ক্ষীণ হয়ে আসছে। হাত ফাঁকা। সঙ্গে আছেন স্বামীও।  মেয়ে ৩২জন। পুরুষ ৯৮ জন। সবমিলিয়ে মোট ১৩০ জন। ঠিক পাঁচ মিনিট এগিয়ে মহিলা-পুরুষ মিলে আরও ১২০জন।  আটকে পড়ে সবাই অসহায়। ফিরতে না পেরে আশঙ্কিত।




রিম্পা বিবির বাচ্চারা পাঁচ  ও আট বছরের। গ্রামের  বাড়িতে পড়ে আছে। রিম্পা কাজে এসেছে দুই বছর। টায়ার বানাতে সহায়কের কাজ করতেন পাঞ্জাবে। ইদে বাড়ি আসার কথা ছিল। বাচ্চারা নতুন জামার জন্য বায়না করছে। রিম্পা বিবি ফোন ধরে অঝরে কঁদেই  চলেছে। বলছেন, " বিষ দিন আপনারা, খ্যায়ে মরে যাই!"

জরিনা বিবি গেছে লকডাউনের দুই মাস আগে কিছু রোজগারের আশায়। নাট বোল্টুর  কাজ করতেন। মাসে তিন  হাজার টাকাও পেয়েছেন।  লকডাউনের জন্য বাকি টাকা আদায় হল না। তবুও ঘরে বসে বসে একদিনের খাবার জুটত। শুধু রুটি। সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে।

সবনম বিবির বয়স কুড়ি। দুই বছরের বাচ্চা নিয়ে জেরবার। স্বামীর হাত ধরে কাজে আসা। ঘরের বিস্কুটও এখন  শেষ। বাইরে যাওয়ার উপায় নেই। গেটে সিকিউরিটি।

মমিনা বিবির দুই বাচ্চা বাড়িতে পড়ে। নয় বছর ধরে কাজ করছেন বাইরে। ফ্ল্যাটবাড়িতে কাজ করেন। সাত হাজার টাকাও পেয়েছিলেন  আগের মাসে। গত দুই মাসের  টাকা পেলেন না। কোনও টাকাও দিতে পারেননি বাড়িতে। আক্ষেপের শেষ নেই।  বাচ্চারা ইদের জামার অপেক্ষায়। ওরা পরব চেনে।  মমিনা আকুতি করে বলছে, "ও দিদি !একটু নিয়ে চলেন না,বাচ্চাদের দিকে মুখ তুলে একবার দেখুন আপনারা। ওরা তো মায়ের জন্য কেঁদে কেঁদে মরছে।"

পারভিনা বিবির দুই বাচ্চা। পাঁচ ও আট বছরের ছেলে। তিনিও কাজ করছেন প্রায় তিন বছর। ফোনে কাঁদতে কাঁদতে বলেছেন, "আমাদের বাড়ি ফিরিয়ে দেওয়ার কেউ নেই গো! ট্রেনের টিকিট কাটার পয়সা নেই। বাড়ি গেলে আপনাদের টাকাটা যেমন করে হোক শোধ করে দেবো। এবারের মত পার করে দিন।"

সবচেয়ে মুশকিল হল এই মহিলা শ্রমিকদের হাড়ভাঙা খাটুনির কোথাও হিসেব নিকেশ নেই। ওরা শুধু  শ্রমিকের বৌ ও শ্রমিকের বাচ্চার মা। ওদের জন্য আলাদা করে কিছু ভাবাই হয় নি। ঘর ছেড়ে,বাচ্চা ছেড়ে মাটি কামড়ে পড়ে রয়েছে ওরা। নিজেস্ব কোনও ইচ্ছা নেই,স্বাধীনতাও নেই। এমন কি অসংগঠিত শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতিটুকুও নেই!


হরিহরপাড়া,মুর্শিদাবাদ

No comments:

Post a Comment

কাথাষ্টিচ শিল্পী সোনালির লকডাউনের দিন

  কাঁথাষ্টিচ শিল্পী সোনালির লকডাউন যাপন    মেয়েদের সুন্দর মুখের নয়, সুন্দর কাজের জয়  সর্বত্র। সাফল্যের সীমানা দিগন্তপার। তাইতো সোনালীদের এত ...