সিনিয়ারার লকডাউন যাপন
মেয়ের স্কুলের মিড ডে মিলের চাল-আলু দিয়ে চলেছে বিশ্বাস পরিবার কিছুদিন। সিনিয়ারার অভাবের সংসারের এ এক চরম বাস্তব। সিনিয়ারা বিড়ি বাঁধে। সংসারের পুরো ভার এখন তার উপর। স্বামী আকবর বিশ্বাসের শিরার অসুখ। রাজমিস্ত্রীর কাজ করত। দুই বছর ধরে বাড়িতে বসে। চেষ্টা করেও লাভ হয়নি। কুর্নি ধরলেই হাত কাঁপে। অগত্যা বেকার হয়ে যাওয়া স্বামী এখন ঘরেই। স্বামী ও দুই মেয়ে নিয়ে ঘর চালাতে সিনিয়ারা জেরবার। মেয়েরাই লকড়ি,পাতা কুড়িয়ে আনে। তাই দিয়েই ঘরের উঠানে মাটির আখা জ্বলে। ভাত কি আর শুধু খাওয়া যায়? আলু তো শেষ হয়ে গেছে কবেই! স্কুল ছুটি তাই মাঝে বেরিয়ে পড়ে দুই মেয়ে শাক-পাতা জোগাড় করতে। গ্রামের মানুষের কাছে লাজনা, পেঁপে চেয়ে আনছে মেয়েরা। তাতেই খাওয়া চলে যাচ্ছে।
লকডাউনের সময় রেশন থেকে ঘরে চাল এসেছে। কিন্তু রান্না করার জ্বালানী নেই। বিড়ি বন্ধ থাকায় সিনিয়ারা আর্থিকভাবে বেকায়দায় পড়েছে। স্বামীর চিকিৎসা বন্ধ হয়েছে। একসময়ে স্বচ্ছল ছিল বাড়ি। কাজ ছিল স্বামীর। উপার্জনও ছিল। সুখের সংসারে হঠাৎ অভাবের কালো ছায়া। সঙ্গে লকডাউন। সিনিয়ারা বলে, "অভাব এসে পড়েছিল আগেই কিন্তু লকডাউনে একদম গরীব হয়ে গেলাম। বিড়ির ইনকামটাই চলে গেল। খাবো কি?"
বছর পচিশের সিনিয়ারার বাল্য বিবাহ। পদ্মাপাড়ে বাপ -মায়ের বাড়ি ভেসে গেছে কবেই। দাম্পত্য প্রায় একযুগ পেরিয়েছে। বিয়ের আগেই বিড়ি বাঁধা শুরু। বিয়ের সময় স্বামীর অবস্থা খারাপ ছিল না। তাই স্বামীর ঘরে এসে বিড়িতে হাত দেয়নি। স্বামী অসুখে পড়ার পর সিনিয়ারা কাজে হাত দেয় নতুন করে। দুই মেয়ের মুখ চেয়ে শুরু করে বিড়ি বাঁধা। বিড়ির উপরেই সংসার ধীরে ধীরে নির্ভর হয়ে পড়ে। লকডাউনে হাত খালি হয়ে গেছে একেবারে। এখন বিকল্প কিছু খুঁজে পাচ্ছে না সিনিয়ারা। রোজা-নামাজ আর আল্লাকে ডাকাই একমাত্র ভরসা সিনিয়ারার। আফশোস করে বলে, "লেখাপড়া বাপ- মায়ে শিখায়নি। কলম এর বদলে হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল বিড়ির গজাল। বই এর বদলে বিড়ির কুলাকেই চিনেছিলাম। আমি সেই এক ভুল করবো না আর। মেয়েদের পড়াশুনা শিখিয়ে বড় অফিসার করব।"
সিনিয়ারারা মেয়েদের জন্য ভরপুর স্বপ্ন দেখে। তারপর একদিন এই মেয়েরাই পরের প্রজন্মের অন্য সিনিয়ারা হয়ে ওঠে। কম বয়সেই সংসারের জোয়াল ঘাড়ে তুলে নেয়! হেঁশেলের অভাবের সঙ্গে লড়তে লড়তে ক্ষয়ে যায়! প্রতিদিন ছেলে-মেয়েদের মুখে দুমুঠো খাবার তুলে দেওয়ার চ্যালেঞ্জের সামনে জীবনের বাকি সব অর্থহীন হয়ে যায়।
দস্তামারা,মুর্শিদাবাদ
No comments:
Post a Comment