আসমা ও বৃষ্টির লকডাউনের দিন
এখন ঘরে কুড়ি কেজি চাল। শাক-পাতা তুলে নিয়ে চলছে হাঁড়ি। রান্না তেল ছাড়াই। আখার জ্বালানি বলতে পড়ে পাওয়া শুকনো পাতা ও লকড়ি। আসমা মন্ডলের সংসারে লকডাউন এভাবেই থাবা বসিয়েছে। গামছা বুনে আয় হত মাসে তেরোশো টাকা। সেই টাকাতেই দুই মেয়ে নিয়ে সংসার আসমার। স্বামী অসংগঠিত শ্রমিক। মাঝে মাঝে কাজে যায়। ফিরে আসে হাজার - বারোশো টাকা নিয়ে। লকডাউনের আগে নিয়ে এসেছে মাত্র ছ'শো টাকা। সংসারের ভার আসমার উপরেই ছিল বরাবর। লকডাউনের ঘোষণায় বন্ধ হয়েছে গামছার কাজ। এদিকে ছাদ থেকে পড়তেই আছে বৃষ্টির জল। মেরামতের নেই সামর্থ্য। লকডাউন চলছেই। নিরুপায় হয়ে তুলে দিতে হল ঘরে বসানো গামছা বুননের তাঁত।
বাড়িতে অভাবের কারনে বৃষ্টির স্কুলের মুখ বেশিদিন দেখা হয়নি। দ্বিতীয় শ্রেণিতেই ইতি টানতে হয়। মায়ের সঙ্গে গামছা বুনানোর সহযোগিতায় পেরিয়ে যাচ্ছে শৈশব ও কিশোর বেলা। আসমার লোক দিয়ে পয়সা রাখার মত আর্থিক ক্ষমতা ছিল না। তাই দুই মেয়েকেই উপার্জনের কাজে লাগাতে হয়। খিদে মেটাতে বিদ্যালয়ের হাতছানি উপেক্ষা করতে হয় বৃষ্টি ও সাগরিকাকে। পরিবারের পেট চালাতে দুই মেয়ে শিক্ষিত হতেই পারল না! আসমা কষ্ট পেয়ে বলে,"দুই মেয়ে আর আমি মুক্ষু-সুক্ষু থাকলাম। জন্ম থেকেই অভাব। তারপর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। আবার সেই অভাবের সঙ্গেই ঘর।"
সারাবছর প্রায় তেল ছাড়াই চলে রান্না তা নিয়ে কষ্ট নেই আসমার। মেয়েকে বিদায় করতে হল এই লকডাউন ঘোষণার সময়। সে নিয়ে জ্বালা আছে আসমার । দুই মেয়েকে ঘরে সামলে রাখার জন্য যে ঘর চাই সেটাও তার নেই। আসমা বলে "বাপ তো প্রায় থাকে না । আমি একা কত দেখবো। কিছু হয়ে গেলে কে দেখবে? তাই চেষ্টা করছিলাম বিয়ে দেওয়ার। আসমা বলে,"খাবারের অভাব। ভাঙা বাড়ি। মেয়েকে আগলে আর কদ্দিন রাখতে পারবো? একটা মাথা কমে গেলে হাঁড়িতে চালও কম লাগবে। শ্বশুরবাড়িতে নিরাপদ থাকবে।
প্রান্তিক জীবনের এই আর্থিক দুঃখ-দুর্দশা অন্তহীন। জরাজীর্ন বাড়ি,ভেঙে পড়া ছাদ,মলিন শাড়ি, জানালায় অত্যন্ত সুনিপুন হাতে সেলাই করা চালের বস্তার পর্দা- এসব কিছুই এই রুক্ষ চুলে ছিপছিপে রোগা চেহারার আসমাকে পরাস্ত করতে পারেনি। নিঃস্ব জীবন কিন্তু নিরানন্দ নয়। পায়ে ছিঁড়ে যাওয়া চটি কিন্তু অভিযোগ নেই কোনও। হাতে পাঁচ টাকা নগদ নেই । কিন্তু অনাহারে ভয় নেই। এই সরল মানুষ গুলো সবার আগে গিয়ে লাইন দিয়ে ভোট দেয়। গণতান্ত্রিক সরকার গঠনে এদের বিনোদন বিহীন সততা সবচেয়ে বেশি। কিন্তু একপুরুষ তারপর দুইপুরুষ চলে যায় এদের জীবনে আড়ম্বর ফেরে না। এদের ঘামের গন্ধ ভালোবাসা সম্বলিত ভাষণ দিয়ে চোখ জুড়ানো পোশাকে দেশনেতা সমাপ্তি টানেন। আর ওই টিলার উপরে একখান ঘরে অনাহার,রোগ নিত্যদিন ঘর বাঁধে। হাঁড়িতে ভাত না থাকার সত্যটা কেমন যেন গল্পের মত শোনায়। লক্ষ -কোটি টাকার যোজনা ও পরিকল্পনার হুংকারে চাপা পড়ে যায় আসমাদের বাদ ছেঁড়া অর্ধেক হাওয়াই চটির বাস্তব। ঢেকে যায় ভেঙেপড়া ছাদের মধ্যে দিয়ে ঢুকে পড়া জলের রাতে বৃষ্টি দিয়ে ভাত মাখানোর দীনতা। লকডাউনের দিনে বৃষ্টিই তরকারীর অভাব পূরণ করে আসমা মন্ডলের সংসারে। যে যেখানে দাঁড়িয়ে আসমাদের দেখে। এবং ভুলেও যায়। কিন্তু চোখের কোন থেকে আসমা-সাগরিকা-বৃষ্টিদের বিশ্বাসের রেখাটা কিছুতেই মিলিয়ে যায় না!
হরিহরপাড়া,তর্তিপুর,মুর্শিদাবাদ
No comments:
Post a Comment